জামানত ছাড়া ঋণ
৫৬ হাজার ছোট উদ্যোক্তা পেয়েছেন ৬০০০ কোটি টাকা
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে দিচ্ছে বিনা জামানতে ঋণ। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশের কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ জামানত ছাড়া বিতরণ করা হয়েছে। যার সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫৬ হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। তাদের সম্পদ সীমিত। ছোট ব্যবসা, পুঁজিও খুব বেশি নয়। নানা শর্ত আর জামানত দিয়ে সব সময় ঋণ নিতে পারেন না তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। কারণ, তারা দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, সিএমএসএমই ঋণ বিতরণে খরচ বেশি, আয় কম। জামানতের অভাবসহ বিভিন্ন অজুহাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অনীহা দেখায়। এসব বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন নীতিমালা শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণখেলাপি করার সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তার সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের হার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএমএসএমই খাতে মোট ছয় হাজার ২৫৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ বিনা জামানতে দিয়েছে। এ ঋণ পেয়েছেন ৫৬ হাজার ২৭১ ছোট উদ্যোক্তা। এর মধ্যে জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৪০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৬ জন
সিএমএসএমই খাতে ঋণ বাড়াতে হলে সরকারের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতা আরও বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যাংকের নিজস্ব কোনো তহবিল নেই। তারা মূলত জামানতকারীদের টাকা বিনিয়োগ করে। তাই, ব্যাংক জামানতবিহীন সিএমএসএমই ঋণ দিতে পারে না। কারণ, জামানত ছাড়া ঋণ দিলে জামানতকারীদের তহবিল ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।’
‘অতএব, ছোট উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ দিতে হলে সরকারকে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় এসব ঋণের গ্যারান্টি দিতে হবে। তাহলেই কেবল সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া সম্ভব। তাই, সরকারের উচিত এ খাতের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে কার্যকর কৌশল ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের তহবিল, পরিধি ও আওতা আরও বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, একটি বৃহৎ ক্রেডিট গ্যারান্টি তহবিলই কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য জামানতবিহীন ঋণের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএমএসএমই খাতে মোট ছয় হাজার ২৫৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ বিনা জামানতে দিয়েছে। এ ঋণ পেয়েছেন ৫৬ হাজার ২৭১ ছোট উদ্যোক্তা। এর মধ্যে জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৪০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৬ জন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিএমএসএমই খাত-সংশ্লিষ্ট তথ্যে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক তিন হাজার ৭৩৭ ছোট উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছে ৯৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বেসরকারি খাতের ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক চার হাজার ২৪৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ৩১ হাজার ৩১২ উদ্যোক্তার মাঝে।
শরিয়াহভিত্তিক আটটি ইসলামী ব্যাংক দুই হাজার ৯৪৮ ছোট উদ্যোক্তার মধ্যে ঋণ দিয়েছে ৩৯৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো ২৮৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ১১ হাজার ৮৫৫ ছোট উদ্যোক্তার মাঝে। এছাড়া ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাঁচ হাজার ৯৬৫ ছোট উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছে এক হাজার ২১৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিএমএসএমই খাতে জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্দেশনা আছে। সেই আলোকে আমরা লক্ষ্য ঠিক করে ঋণ দিয়ে যাচ্ছি। ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণের আদায় ভালো। আর দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছোট উদ্যোক্তারা। তাদের সহায়তায় আমাদের চলমান ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ, আমাদের এখন টাকার অভাব নেই। শুধু ভালো উদ্যোক্তা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সিএমএসএমই খাত। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। এ কারণে সিএমএসএমই খাত সম্প্রসারণে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে কয়েক বছর ধরে বড় ঋণ গুটিয়ে সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ স্থিতির মধ্যে সিএমএসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে বাড়ানো অব্যাহত রাখতে হবে। এভাবে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি এ খাতে বিতরণ হওয়া ঋণের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ও ক্ষুদ্র (সিএমএসই) উদ্যোক্তাদের দিতে হবে।
এছাড়া একটি টেকসই সিএমএসএমই খাত গঠনের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের মধ্যে এ খাতের উৎপাদনশীল অংশে ৪০ শতাংশ, সেবায় ২৫ শতাংশ এবং ব্যবসায় সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে।
এসআই/এমএআর/