দ্রুত অবনতি হওয়া করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) ‘সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি কী অর্থনীতির বর্তমান চাহিদা মেটাতে পারবে? সিপিডি’র তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনায় সিপিডি’র পক্ষ থেকে এ মন্তব্য করা হয়েছে।

আলোচনায় চলমান মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে ঘোষিত এই মুদ্রানীতি কতটা সহায়ক হবে তা নিয়েও আলোকপাত করা হয়। এছাড়া মুদ্রানীতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা এবং লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়।

সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন- সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

সিপিডি বলছে, গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। চলমান করোনা অতিমারিকালে এটি দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। অতিমারির কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুদ্রানীতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় যে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণে অর্থনৈতিক সংকোচন, কাজ হারানো ও দারিদ্রতা বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র পরিবারের ব্যয় করার সক্ষমতা কমে আসবে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া আছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রাখতে, ব্যাংকিং খাতে আগে থেকে বিদ্যমান বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে হবে।

সিপিডির প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ড. ফাহমিদা বলেন, সার্বিকভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিকে এ অতিমারির বিশৃঙ্খল সময়ের বিবেচনায় একটি সতর্কতামূলক নীতি বলেই মনে হয়। সামগ্রিকভাবে এ মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমূলক। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতিকে প্রয়োজনে পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছে। বর্তমানে দ্রুত অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণ নাও হতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যগুলো বাস্তবিক হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে অর্থনীতিকে আবার সচল করতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। যদিও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায়নি।

উপস্থাপনায় সুপারিশ করা হয়েছে, ঋণ খেলাপি এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত ব্যাংকগুলোকে করোনা সম্পর্কিত সহায়তা প্যাকেজের সুবিধার আওতায় আসার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। বেজেল থ্রি বা ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্টের আওতায় না থাকা ব্যাংকগুলোকে এই সুযোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। স্বচ্ছ এবং বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাকে চিহ্নিত করা উচিত। সহায়তা প্যাকেজ বিতরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং মাসিক ভিত্তিতে বিতরণ পর্যায়ে আরও বিভাজিত তথ্যউপাত্ত প্রয়োজন রয়েছে। এসব সহায়তা প্যাকেজ দ্রুত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক এবং স্বল্প আয়ের মানুষের আছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনা অতিমারির অভিঘাতের ব্যাপ্তি, সহায়তার পরিমাণ এবং কাদের সহায়তা দেওয়া উচিত তা নিয়ে একটি বিস্তারিত মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশব্যাপী প্রচার-প্রচারণার চালানো দরকার। যেন এসব সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক ও যোগ্য মানুষ প্যাকেজগুলো সম্পর্কে অবগত হতে পারে। তারল্য সহায়তা ছোট ঋণগ্রহীতা ও নতুন ঋণগ্রহীতার এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপযুক্ত। এজন্য সরকারে উচিত সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া যাতে এ গোষ্ঠীগুলো করোনা অতিমারির ধাক্কা সামলে উঠতে পারে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বাণিজ্য সংস্থা, নাগরিক সমাজ, বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে করোনা তারল্য সহায়তা এবং আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ পর্যবেক্ষণ এবং তাদের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয় সিপিডি’র পক্ষ থেকে।

সংস্থাটির মতে, অতিরিক্ত তারল্যযুক্ত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলার কারণ চিহ্নিত করা, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং এ পরিস্থিতি থেকে টেকসই পরিত্রাণ পেতে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

আরএম/এসএসএইচ