করোনা কেড়েছে ১৪৩ ব্যাংকারের প্রাণ
কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না করোনার সংক্রমণ। দিনদিন এর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে, জরুরি সেবা হিসেবে সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে ব্যাংকের কার্যক্রম। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নানা প্রতিবন্ধকতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও কাজ করছেন ব্যাংকাররা। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। গত ৫ এপ্রিল থেকে সাধারণের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পর্যায়ক্রমে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থাকবে সারাদেশ।
বিজ্ঞাপন
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র জুন মাসে এক হাজার ৮৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হন। মারা যান ১০ ব্যাংকার। এছাড়া উপসর্গ দেখা যায় সহস্রাধিক কর্মীর শরীরে। তারা বলেন, সাধারণ ছুটি, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ; সবসময়ই জরুরি সেবা হিসেবে ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় অফিসে যাতায়াত এবং ব্যাংকিং সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় সামাজিক দূরত্ব ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ব্যাংকাররা। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।
সাধারণ ছুটি, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ; সবসময়ই জরুরি সেবা হিসেবে ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় অফিসে যাতায়াত এবং ব্যাংকিং সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় সামাজিক দূরত্ব ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ব্যাংকাররা। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা
স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অধিক কর্মীসমাগম ঠেকাতে অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর জোর দেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২৭ হাজার ২৩৭ কর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন মারা যান। গত মে মাস পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৪০০ জন। ওই সময় পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল ১৩৩ জন। এ হিসাবে গেল জুন মাসে এক হাজার ৮৩৭ ব্যাংককর্মী করোনায় আক্রান্ত হন। মারা যান ১০ জন।
করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যাংককর্মী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের। ব্যাংকটিতে এখন পর্যন্ত ২৭ কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে গত বছর মারা যান ২২ জন। চলতি বছর না ফেরার দেশে পাড়ি দেন পাঁচজন।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২৭ হাজার ২৩৭ কর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন মারা যান। গত মে মাস পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৪০০ জন। ওই সময় পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল ১৩৩ জন। এ হিসাবে গেল জুন মাসে এক হাজার ৮৩৭ ব্যাংককর্মী করোনায় আক্রান্ত হন। মারা যান ১০ জন
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ১১ জন এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাত কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এ বিষয়ে বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংক চালু রাখা জরুরি। এর বিকল্প নেই। আমরাও ব্যাংকারদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ঘোষিত সব নিয়মকানুন পরিপালনের চেষ্টা করছি। কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করছেন। পাশাপাশি সাপ্তাহিক বাই-রোটেশন (চক্রাকারে) ডিউটির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যাতে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ না পড়ে।
‘এরপরও আমাদের কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে, ব্যয়ও বহন করা হচ্ছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আক্রান্ত ও মারা যাওয়া কর্মীদের সব ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে’— বলেন এ কর্মকর্তা।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ব্যাংককর্মীদের মধ্যে প্রথম মারা যান সিটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের ফার্স্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট মুজতবা শাহরিয়ার (৪০)। গত বছরের ২৬ এপ্রিল সকালে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওই ঘটনার পর প্রাণঘাতী করোনার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংককর্মীদের কাজে ফেরাতে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ঝুঁকিবিমাসহ যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে এককালীন আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংকসেবা চালু রাখতেই হবে। এজন্য কর্মীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সরকারের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করে সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সর্বশেষ নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে পদভেদে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবেন। এ অর্থ কোনোভাবেই কর্মীর ঋণ বা অন্য কোনো দায়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। এ ভাইরাস বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে ৫০ লাখের অধিক মানুষের প্রাণ কেড়েছে।
২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। এরপর সরকার সাধারণ ছুটি, লকডাউনসহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। কিন্তু কোনোভাবেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। মারাত্মক ভারতীয় ধরন দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা সারাদেশে বিস্তার লাভ করে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে সাধারণের চলাচলের ওপর ফের বিধিনিষেধ আরোপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরও কয়েক দফা বাড়ানো হয়। কোরবানি ঈদের সময় বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হয়। সর্বশেষ ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) রাত ১২টা পর্যন্ত বাড়ানো হয় এ বিধিনিষেধ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য (২৬ জুলাই) অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৫২১ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৭ জন। সুস্থ হয়েছেন ১০ লাখ নয় হাজার ৯২৩ জন।
এসআই/এমএআর/