মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ‘বুঝে-শুনে’ চামড়া কেনার পরামর্শ
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোরবানির পশুর চামড়া ‘বুঝে-শুনে’ কেনার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রামের চামড়ার আড়তদাররা। বেশি দামে চামড়া কিনলে এ বছরও লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে সতর্ক করেছেন তারা। সেইসঙ্গে চামড়া আলাদা করার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দেওয়ার কথা বলছেন আড়তদাররা।
আড়তদাররা বলছেন, চট্টগ্রামে মাত্র একটি ট্যানারি থাকায় ঢাকার ব্যবসায়ীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তাদের। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের চামড়া বিক্রির ২০ কোটি টাকা এখনও বকেয়া রয়েছে। বকেয়া টাকা ফেরত না পেলে চট্টগ্রামের অনেক আড়তদার এবারও চামড়া কিনতে পারবেন না। পাশাপাশি ২৩ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া বিধিনিষেধে চামড়া খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
এবার চট্টগ্রামে কম পশু কোরবানি দেওয়া হবে
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেটা সংরক্ষণ করার পরের দাম। তাই যারা চামড়া কিনবেন সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, চামড়া কেনার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। করোনাকালে চট্টগ্রামে এবার কোরবানি কম হবে। আমরা ধারণা করছি এ বছর গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া মিলে চার লাখের মতো পশু কোরবানি হবে। যারা মাঠপর্যায়ে চামড়া ক্রয় করবেন, তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, কোরবানির দিন চামড়া আলাদা করার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দেওয়ার জন্য। তাহলে চামড়া নষ্ট হবে না। পরেও চামড়া বিক্রি করতে পারবেন। তাহলে ২০১৯ ও ২০ সালের মতো চামড়া নষ্ট হবে না।
তিনি আরও বলেন, ট্যানারি ও চামড়ার আড়ত যেন সরকারের লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা কাজ করতে পারবেন না।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদার সমিতি জানায়, চলতি বছর কোরবানির সময় গরু, মহিষ, ছাগলসহ প্রায় চার লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখ গরুর চামড়া। আর এক লাখ ছাগলসহ অন্যান্য পশুর চামড়া ধরা হয়েছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সদস্য ১১২ জন। সমিতির নেতারা বলছেন, এর মধ্যে কিছু সদস্য লোকসানে পড়ে চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির প্রায় ২০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ টাকা ঈদের আগে না পেলে অনেক ব্যবসায়ী চামড়া কিনতে পারবেন না। ফলে চামড়া নিয়ে সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে লবণ দেওয়া প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে হিসেবে এবার পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে গরুর চামড়ার দাম।
প্রতি বর্গফুট চামড়া কিনতে হবে ১৮-২০ টাকার মধ্যে
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি মো. আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রতি বর্গফুট চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকার মধ্যে কিনতে হবে। এরপর ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে হবে। এর বেশি দামে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করলে আড়তদাররা তাদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করতে পারবে না। ফলে গত দুই বছরের মতো চামড়া অবিক্রীত থেকে যাবে। আড়তদাররা চামড়া কেনার পরে প্রতি বর্গফুটে ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ আছে। তারপর লবণের দাম বেড়ে গেছে বস্তাপ্রতি ১৫০ টাকা। করোনা মহামারির কারণে শ্রমিকদের খরচও বেশি। তাই মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের বুঝে-শুনে চামড়া ক্রয় করতে হবে।
তিনি বলেন, সংরক্ষণের পদ্ধতি না জানার কারণে অনেক চামড়া নষ্ট হয়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ বিষয়টি জানেন না। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না করলে নষ্ট হয়ে যায়। যারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চামড়া কেনেন তারা বিক্রি করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে ফড়িয়াদের কাছে। ফড়িয়ারা বিক্রি করে আমাদের কাছে। আমাদের কাছে আসতে আসতে অনেক সময় চামড়া নষ্ট হয়ে যায়।
বাজার সম্পর্কে ধারণা নেই অধিকাংশ মৌসুমি ব্যবসায়ীর
আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার বাজার সম্পর্কে ধারণা না রেখে বেশি দামে চামড়া কেনেন। আর আড়তদারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতে চান। এ কারণে আড়তদাররা তাদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করতে পারেন না। ফলে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। আশা করি এ বছর কোনো চামড়া নষ্ট হবে না।
তিনি বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। আমি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, বুঝে-শুনে চামড়া ক্রয় করতে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করার পর আমাদের প্রতি বর্গফুটে খরচ করতে হয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা। তাহলে আমাদের চামড়া কিনতে হবে ২০ থেকে ২২ টাকা ফুটে। ওই হিসেব করেই মৌসুমি ও ফড়িয়াদের চামড়া কিনতে হবে। তাহলেই তাদের থেকে আমরা চামড়া ক্রয় করতে পারবো। চামড়াও নষ্ট হবে না।
মো. আব্দুল কাদের বলেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে আমারা চট্টগ্রামের আড়তদাররা প্রায় ২০ কোটি টাকা পাবো। লোকসান দিতে দিতে অনেক সদস্য চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসা অনেকটা ঢাকার উপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রামে বর্তমানে মাত্র একটি ট্যানারি আছে। আগে ২০টির উপরে ট্যানারি ছিল। তবে ঢাকার কিছু ভালো ট্যানারি আছে যারা অগ্রিম টাকা দিয়ে চামড়া কেনে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্পের জন্য আলাদা জোন করা দরকার। সরকার থেকে ঋণসহ সব সুযোগ সুবিধা ট্যানারি মালিকরা পাচ্ছেন। আমরা কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি না। আমরা নিজের টাকায় ব্যবসা করি, সে টাকা ট্যানারি মালিকরা বছরের পর বছর আটকে রাখে।
রীফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোখলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন বছর ধরে বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা কমে গছে। সেইসঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রভাবও যুক্ত হয়েছে। তবে ইউরোপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাওয়ায় চামড়া রফতানি বাড়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের সড়কে ফেলে রাখা হয় বিপুল পরিমাণ কোরবানির পশুর চামড়া। ওই বছর প্রায় ১ লাখ চামড়া নষ্ট হয়েছিল চট্টগ্রামে। এছাড়া গতবছরও ১৫ হাজার চামড়া বিক্রি করতে না পেরে সড়কে ফেলে রেখেছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
কেএম/এসকেডি