ক্রেতার অর্ডার করা পণ্য দিতে গড়িমসি; নানা অনিয়ম আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলছে ব্যবসা; সম্পদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি দেনা। এমন সব অভিযোগের কারণে ইভ্যালির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তাদের গিফট ভাউচারেও দিচ্ছে না পণ্য। অন্যদিকে মূল্য ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান কার্যালয় বন্ধ রেখেছে ইভ্যালি। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা।

রাজধানীর ধানমন্ডির সোবহানবাগে ইভ্যালি প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে অনেক গ্রাহক অফিস বন্ধ দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন। প্রতিষ্ঠানটির হট লাইনে কল করলেও ব্যস্ত দেখাচ্ছে। ইভ্যালি বলছে, করোনার কারণে এখন অফিস বন্ধ। তবে অনলাইনে গ্রাহকদের সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে।

ইভ্যালির কার্যালয় বন্ধের বিষয়ে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে লিখিত জানানো হয়, ইভ্যালির কার্যালয় বন্ধ নয় বরং করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার নির্ধারিত বিধিনিষেধের আলোকে দাফতরিক কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধু জরুরি সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভাগের লোকবলই অফিসে উপস্থিত হয়ে সরাসরি কাজ করছেন। আমাদের তিনটি ওয়্যারহাউজ আছে। সেখানেও আমাদের কর্মীরা গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত আছেন। গ্রাহকেরা নিয়মিতভাবে তাদের অর্ডার করা পণ্যের ডেলিভারি পাচ্ছেন।

সরকারি বিধিনিষেধের আলোকে ব্যাপক লোক সমাগম এড়াতে অফিস থেকে সশরীরে গ্রাহক সেবা দেওয়া সাময়িক বন্ধ আছে। তবে গ্রাহকেরা আমাদের ওয়েবসাইট, অ্যাপ প্ল্যাটফর্ম ও ফেসবুক থেকে নিয়মিত সেবা নিতে পারছেন। একই সঙ্গে আমাদের গ্রাহক সেবা কেন্দ্র হটলাইন নম্বর প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সক্রিয় আছে। লকডাউন ব্যতীত এই সেবা ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিনই চালু থাকে।

তবে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন, মাসের পর মাস যাচ্ছে, কেনা পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে না ইভ্যালি। কার্যালয় বন্ধ। তাদের হটলাইনে ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অভিযোগের পর ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ারে (০৯৬৩৮১১১৬৬৬) ফোন করা হয়। প্রথমে নেটওয়ার্ক ব্যস্ত দেখালেও পরে কল ঢোকে, কিন্তু কাস্টমার কেয়ারের কেউ কলটি ধরেননি।

এদিকে ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেশকিছু পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাউচারের বিপরীতে পাওনা অর্থ পরিশোধ না করায় তারা আর পণ্য দিচ্ছে না। সম্প্রতি ইভ্যালির গিফট ভাউচারে কেনাকাটার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে।

এমনই একটি প্রতিষ্ঠান দেশি পোশাকের ব্র্যান্ড ‘রঙ বাংলাদেশ’। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের উদ্দেশ্যে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গ্রাহকদের কেনা গিফট ভাউচারের পেমেন্ট ইভ্যালি আমাদের পরিশোধ না করায় ভাউচারটি এই মুর্হূতে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে পেমেন্ট পরিশোধ করলে আপনি অবশ্যই এই ভাউচার ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে পারবেন। এমতাবস্থায় ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানিয়েছে ‘রঙ বাংলাদেশ’।

এর আগে নানা অনিয়মের কারণে ইভ্যালিসহ ১০টি অনলাইন মার্চেন্টে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থ‌গিত করেছে বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর মধ্যে আছে ডাচ বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এম‌টি‌বি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। পাশাপাশি ইউসিবি ও সিটি ব্যাংকও তাদের গ্রাহকদের এসব অনলাইন মার্চেন্টে লেনদেনের বিষয়ে সতর্ক করেছে।

এর আগে ইভ্যালির ‘সম্পদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি দেনা’ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে উঠে আসে ইভ্যালির মোট দায় ৪০৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছে ২১৪ কোটি টাকা, আর মার্চেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছে ১৯০ কোটি টাকার। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কমপক্ষে ৪০৪ কোটি টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা। কিন্তু সম্পদ আছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার।

এছাড়া গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালির নেওয়া অগ্রিম ৩৩৯ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ টাকা আত্মসাৎ বা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

ইভ্যালির ওপর করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের ৪ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠান চারটি হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এরপর দুদকের পক্ষ থেকে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরীন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেলের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়া হয়।

এদিকে অনিয়ন্ত্রিত ইকমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতির মধ্যে আনতে গত ৪ জুলাই দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয় আদেশ দেওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে, ভিন্ন শহরে থাকলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে, মূল্য পরিশোধের ১০ দিনের মধ্যে ক্রেতার পুরো টাকা ফেরত দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই গ্রাহকের পণ্য বা সেবা বুঝিয়ে না দিয়ে বিক্রয় মূল্য পাবে না জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেমেন্ট নির্দেশনা জারি করে।  

এসআই/ওএফ/জেএস