শহরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রায় এক হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৮৯৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হচ্ছে।

প্রকল্পটিতে হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হলেও এটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ উঠেছে। কারণ, বর্তমান প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এখানে ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে প্রকল্পের অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কাজে নেমে এসেছে ধীরগতি।

মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী মন্ত্রীর পিএস, প্রকল্প পরিচালক ছাড়াও নগর উন্নয়ন-১ অধিশাখা ও নগর উন্নয়ন-৩ অধিশাখার দায়িত্বে আছেন। এমন ব্যস্ততম একজনকে এত বড় প্রকল্পে দায়িত্ব দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়িত ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি- দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি তৃতীয় পক্ষ দিয়ে করিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

‘রিড লিমিটেড’ কোম্পানির মাধ্যমে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনটি চলতি বছরের জুনে তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। 
 

নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত তিন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকল্পের শুরু থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল হাকিম মজুমদার প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ডা. শারমিন মিজান ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের একান্ত সচিব (পিএস) ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী।

সরকারের প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগকে দায়িত্বশীল হতে হবে। এ প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক একজন দক্ষ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও এটা তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। ফলে প্রকল্পের পরিচালন ও বাস্তবায়নসহ উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে

স্থানীয় সরকার বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী মন্ত্রীর পিএস, প্রকল্প পরিচালক ছাড়াও নগর উন্নয়ন-১ অধিশাখা ও নগর উন্নয়ন-৩ অধিশাখার দায়িত্বে আছেন। এমন ব্যস্ততম একজনকে এত বড় প্রকল্পে দায়িত্ব দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনটি তৈরির পর আইএমইডি সচিবের সভাপতিত্বে প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে সভা হয়। কিন্তু ওই সভার শুরুতে প্রকল্প পরিচালক উপস্থিত হতে পারেননি। সভার শেষের দিকে যুক্ত হন তিনি।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারের প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগকে দায়িত্বশীল হতে হবে। এ প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক একজন দক্ষ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও এটা তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। ফলে প্রকল্পের পরিচালন ও বাস্তবায়নসহ উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি প্রকল্পে একজন পিডি (প্রকল্প পরিচালক) থাকবেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা আছে। আমার এ মুহূর্তে সময়টা মনে পড়ছে না, তবে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রী একনেক সভায় একাধিকবার পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালকের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ একজনকে একাধিক প্রকল্পে দায়িত্ব দিচ্ছেন। এ ধরনের বিষয়গুলো নজরে এলে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে পরামর্শ দেই।’

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এক মাস আগে নতুন পিডি নিয়োগ হয়েছে। পিডি না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখানে দায়িত্ব পালন করেছি।’ 

তবে আইএমইডি’র কর্মকর্তারা জানান, গত ১২ জুন নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনটির ওপর সভা হয়েছে। সেখানে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নূরে আলম সিদ্দিকী যোগ দেন।

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা পরিচালনার জন্য প্রকল্পভুক্ত এলাকা থেকে পরিমাণগত ও গুণগত উভয় পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক, সহযোগী এনজিও, বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ মোট ৭২ জনের নিবিড় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া পরিমাণগত সমীক্ষার জন্য এক হাজার ২৮০ জন উপকারভোগীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ, আটটি দলীয় আলোচনা অনুষ্ঠান এবং স্থানীয় পর্যায়ে একটি অর্ধদিবস কর্মশালার মাধ্যমে প্রতিবেদনের তথ্য নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের ঝুঁকির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘একজন দক্ষ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অভাব রয়েছে। কোনো আইসিইউ না থাকায় অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ রোগীকে ডেলিভারি করানো যায় না। প্রকল্পের মাধ্যমে সেবাপ্রদানকারীদের চাকরির কোনো স্থায়িত্ব নেই। প্রত্যেক কেন্দ্রে মাত্র একজন নিরাপত্তাপ্রহরী রয়েছে, যা অপ্রতুল। প্রত্যেক কেন্দ্রে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক রয়েছেন। ফলে অনেক সময় জরুরি সেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।’

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, প্রকল্পের অগ্রগতিতে মূল বাধা সময়মতো পণ্য, কাজ ও সেবা সংগ্রহে ব্যর্থতা; যা প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত। দ্রুত ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান এবং তা নিরসন করতে হবে। প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রদানের নিমিত্তে নিয়মিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা করা প্রয়োজন।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটির মাধ্যমে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা নগর মাতৃসদন থেকে সেবা নিয়ে ৫৬ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। এর মধ্যে খুবই সন্তুষ্ট ৩৬ শতাংশ মানুষ। তবে ৮ শতাংশ মানুষ মাতৃসদনের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় বলে জানান উপকারভোগীরা। অসন্তুষ্টির কারণ সম্পর্কে তারা জানান, শিশুর টিকা দিতে বেশি সময় লাগে। ওষুধের অপর্যাপ্ততা ও সেবাপ্রদানকারীদের দক্ষতার অভাব আছে। নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা মাতৃসদনে যন্ত্রপাতির বিষয়ে শতকরা ৭১ ভাগ উপকারভোগী সন্তুষ্ট হলেও ১১ ভাগ সন্তুষ্ট নন। ১৮ ভাগ লোক সেবা কেন্দ্রগুলোর যন্ত্রপাতি সম্পর্কে অবহিত নন।

চলমান প্রকল্পটি সরকারের একটি ‘বাস্তবমুখী প্রকল্প’ বলে অভিহিত করেছে আইএমইডি। প্রকল্পটি শুরুর পর শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়েছে। সেবাগ্রহীতাদের মানসিক ও দৈহিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য প্রকল্পটি অত্যন্ত উপযোগী। নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরোধমূলক প্রতিষেধক চিকিৎসা, সঠিক পরামর্শ প্রদান ও রেফারেল সেবা দেওয়া হয়। এজন্য প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এর সেবাদান অব্যাহত রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন।

এসআর/এসএম/এমএআর