জিজ্ঞাসাবাদে যা বললেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ কর্মকর্তা
অর্থের বিনিময়ে অনিয়ম গোপন ও নানা কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগিতা করেন সাবেক-বর্তমান আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নরসহ (ডিজি) পাঁচ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণ উদঘাটনে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদ্ঘাটন) কমিটি।
বিজ্ঞাপন
অভিযুক্তরা হলেন : সাবেক ডিজি এস কে সুর, এস এম মনিরুজ্জামান, সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।
মঙ্গলবার (২২ জুন) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খান তাদের দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সকাল ১১টা থেকে ধারাবাহিকভাবে বিকাল ৬টা পর্যন্ত চলে এ জিজ্ঞাসাবাদ। প্রথমে সাবেক ডিজি এস কে সুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর একে একে বাকি ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুই ডিজিসহ সাবেক বর্তমান পাঁচ প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে কমিটি প্রধান এ কে এম সাজেদুর রহমান খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো বিষয় সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মুখপাত্রের মাধ্যমে জানানো হবে। তবে আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মঙ্গলবার (২২ জুন) সকাল ১১টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীকে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার সময় এস কে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সবই মিথ্যা। আমার যা বলার তা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে বলেছি। এরপর তিনি দ্রুত গাড়িতে উঠে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলে যান।
এরপর সাবেক ডিজি এস এম মনিরুজ্জামানের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তাকেও প্রায় দুই ঘণ্টা চলে জিজ্ঞাসাবাদ। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে কিছু বলতে রাজি না হলেও পরে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাকে ডেকেছিল তাই দেখা করতে এসেছি। কোন অভিযোগের ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তারাই (বাংলাদেশ ব্যাংক) ভালো জানে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে দাবি করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ওই সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে থাকায় আমাকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে এই কমিটি বিআইএফসির পাশাপাশি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ঘটনাও খতিয়ে দেখছে।
এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসির আমানতকারীদের মামলা শুনানিতে আদালতের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে সভাপতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে কমিটির সদস্য সচিব করে 'কারণ উদ্ঘাটন’ (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪ এর মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন। আর আদালত থেকে কমিটিতে রয়েছেন দুজন। তারা হলেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মহিদুল ইসলাম ও সাবেক সচিব নুরুর রহমান।
জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য চাপা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। এসব অনিয়মে সহায়তা করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিনিময়ে পেতেন আর্থিক সুবিধা। ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেছেন আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক।
আদালতে জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে ঘুষ দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো দুই লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, '২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেসব এজিএম-ডিজিএম ছিল, তারা বসে বসে মধু খেত। তাই তারা চুপ থাকত।' এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে 'চোর' ও 'ডাকাত' বলেও উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগের বিষয়ে সমালোচনার ঝড় তোলেন অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টনক নড়ে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদ্ঘাটন) কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটিতে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে প্রধান ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন।
এসআই/এসকেডি/জেএস