খরচের জায়গা নেই, নেই ঋণের চাপও
২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেয়। মহামারির কারণে চলতি অর্থবছরে ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র মিলছে ভিন্ন। করোনার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) কাজের গতি কমেছে। ফলে উন্নয়ন ব্যয়ও কম হয়েছে। অন্যদিকে, বিদেশি ঋণ, অনুদান ও সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ব্যাংক ঋণ করতে হচ্ছে না। উল্টো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে সরকার।
অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় উন্নয়ন প্রকল্পের তেমন কাজ না হওয়ায় সরকারের ব্যয় কম হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে, বিদেশি ঋণের অনুদানও আসছে। ফলে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে, এখন ঋণ নেয়নি বলে আগামীতে নেবে না; সেটা বলা যাচ্ছে না। হঠাৎ এডিপির বাস্তবায়ন বেড়ে যেতে পারে। তখন সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে। কত টাকা ঋণ নেবে তা নির্ভয় করবে এডিপি বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আহরণের ওপর।
বিজ্ঞাপন
অর্থবছরের শুরু থেকে গত ৫ মে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। তবে, এ সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ধার করেনি। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ২৮ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা শোধ করেছে। এতে চলতি অর্থবছরের ৫ মে পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। যেখানে পুরো অর্থবছরে সরকারের প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা
২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেয়। ফলে গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৭৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। করোনার প্রভাবে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কাসহ নানা কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করে। তবে ঋণের চাহিদা কম থাকায় এ লক্ষ্য থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে ৮২ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, অর্থবছরের শুরু থেকে গত ৫ মে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। তবে, এ সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ধার করেনি। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ২৮ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা শোধ করেছে। এতে চলতি অর্থবছরের ৫ মে পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। যেখানে পুরো অর্থবছরে সরকারের প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা ছিল।
গত অর্থবছর শেষে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩০ জুন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণস্থিতি ছিল এক লাখ ৭৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৫ মে পর্যন্ত এ ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থবছরের বিগত মাসগুলোতে এডিপি বাস্তবায়ন কম ছিল। তাই অর্থ নেয়নি সরকার। তবে, অর্থবছরের শেষে যে নেবে না, সেটা বলা যাবে না। কারণ, এখনও সময় আছে। হঠাৎ দেখা যাবে এডিপি বাস্তবায়ন বেড়ে গেছে। সরকার তখন ঠিকই ঋণ নেবে।
‘এখন যে অবস্থা দেখছি, শেষ সময় অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। সরকার ব্যাংক থেকে ধার করবে অবশ্যই; কিন্তু কত করবে তা দেখার বিষয়। এটি নির্ভয় করবে কতটুকু এডিপি বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আহরণ হলো তার ওপর।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, সরকারের বিভিন্ন পেমেন্ট, ঋণ, সুদ পরিশোধ সবসময় বছর শেষে হয়ে থাকে। আবার এডিপি বাস্তবায়ন সারা বছর ধীরগতি থাকে, শেষ দুই মাসে গতি বেড়ে যায়। এখন ১০ মাসে ৫০ শতাংশ হলেও বছর শেষে দেখা যাবে তড়িঘড়ি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজ দেখাবে। তাই এখনও সময় আছে। জুনের ৩০ তারিখ প্রকৃত তথ্য জানা যাবে।
ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংক খাতের ওপর তেমন চাপ আসবে না জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেবে তাতে চাপ তেমন পড়বে না। আর যদি চাপ মনে হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়ে ট্রেজারি বিল ইস্যু করে দেবে; বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৮৫ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল ৫২ হাজার ৯৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে। সেই হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সরকারের সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি এডিপি। এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে ৪৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
উন্নয়ন প্রকল্পের তেমন কাজ না হওয়ায় সরকারের অর্থের চাহিদা কম। অন্যদিকে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়েছে, বিদেশি ঋণ অনুদানও আসছে। ফলে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কম হয়েছে। বড় বড় মেগা প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে। তবে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল ছাড়া অন্যদের অগ্রগতি খুবই কম। এসব কারণে সরকারের অর্থের চাহিদা কম ছিল। তাই ঋণ তেমন নেয়নি।
তিনি আরও বলেন, করোনায় স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার খাত ছাড়া কাজ করার সুযোগ কম ছিল। তারপরও স্বাস্থ্য খাতের তেমন অগ্রগতি নেই। অদক্ষ কর্মীদের কারণে স্বাস্থ্য খাতে আশানুরূপ উন্নয়নও হচ্ছে না। ফলে অর্থ ব্যয় হয়নি। এছাড়া এবার গ্রাহক অনেক সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বিক্রি বেশি হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়নি।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৬৩ কোটি সাত লাখ টাকা। ঘাটতি ৪৯ হাজার ৫০১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ১১৭ কোটি সাত লাখ টাকা।
এসআই/এইচকে/এমএআর/