নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও বছরের পর বছর আদায় হচ্ছে না ঋণ। ব্যাংকগুলোতে ‘মন্দ ঋণ’ বা শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে অনেক মন্দ ঋণ আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের বোঝা কাগজে-কলমে কমাতে ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের পথ বেছে নিয়েছে ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যা এর আগের বছরের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। ২০১৯ সালে অবলোপনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। কিন্তু অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ের হার এক শতাংশেরও কম।
 
অবলোপন থেকে ঋণ আদায় নেই বললেই চলে। তারপরও অবলোপনে ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার জন্যেও অতিরিক্ত সময় পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত কয়েক বছর ধরেই এ প্রভিশন সংরক্ষণের অতিরিক্ত সময় নিয়ে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকসহ এ সুবিধা নিয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) অবলোপন থেকে আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে শূন্য দশমিক ২৭ এবং চতুর্থ বা শেষ প্রান্তিকে আদায়ের হার ছিল ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এরপরেও নতুন করে অত্যাধিক ঋণ অবলোপনকে আত্মঘাতী হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা।

মন্দ বা ক্ষতিকর মানের খেলাপি ঋণকে স্থিতিপত্র (ব্যালান্সশিট) থেকে বাদ দেওয়াকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণখেলাপি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় ব্যাংকের স্থিতিপত্র ঠিক রাখতে অবলোপনের নীতিমালা জারি হয়। অবলোপন হওয়া মানে ঋণ মাফ হয়ে যাওয়া নয়, এই ঋণ গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয়। এতে সুবিধা হলো গ্রাহক নিজে খেলাপি হয় না আবার ব্যাংকও খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা কম দেখাতে পারে। তবে অভিযোগ আছে, এই অবলোপন পদ্ধতির ফায়দা নিচ্ছে অনেক গ্রাহক। তারা পরে ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করছেন না।  

২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অবলোপন সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে ৩ বছর হলেই মন্দমানের (কু-ঋণ) খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো। আগে ৫ বছর না হলে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত না। এছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করার সুযোগ ছিল; এখন তা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। মূলত কাগজে–কলমে খেলাপি কম দেখাতে এ সুবিধা নিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো।  

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় ঋণ খেলাপিরা উৎসাহিত হয়েছেন। এখন তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ব্যালান্সশিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলোও এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়। এসব ব্যাংকে পাঁচ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়। যা ব্যাংক খাতের মোট অবলোপনের ৭৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকগুলো অবলোপন করে ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বাকি ৩৩ কোটি টাকা অবলোপন করে।

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কিছু অর্থ আদায়ের পর স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্থিতির পরিমাণ ১৭ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্থিতি ২৫ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকে ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোয় স্থিতির পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, অনেক যাচাই-বাছাই করার পর আমাদের অবলোপন করতে হয়। এ কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোয় অবলোপনের হার কমেছে। তবে এখন আমরা ভালো গ্রাহক খুঁজছি। সহজ শর্তে কম সুদে ঋণ দেবো যেন খেলাপি না হয়।

প্রভিশন ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক হওয়ায় বিনামূল্যে সরকারকে আমরা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকি। যেখান থেকে আমাদের কোনো আয় নেই। দেশের উন্নয়নে এসব কাজ করছি। আমরা সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছি। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, ছাত্রদের কল্যাণ তহবিলের টাকা বিনা মূল্যে বিতরণ করে আসছি। এসব সেবার মূল্য নিলে আমাদের বাড়তি আয় হতো। তাহলে প্রভিশনের কোনো ঘাটতি থাকত না, উল্টো  আয় বাড়ত।

এসআই/এসকেডি/জেএস