সামিট পাওয়ারের কর ফাঁকি ১১১৩ কোটি টাকা
দেশের আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ সামিট। অভিযোগ রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানি খাতে সবচেয়ে সুবিধা নিয়েছে গ্রুপটি। এবার গ্রুপটির দুই প্রতিষ্ঠান ‘সামিট পাওয়ার’ ও ‘সামিট কর্পোরেশন’-এর প্রায় এক হাজার ১১৩ কোটি টাকার কর ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল- সিআইসি।
সিআইসি থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে এনবিআরের আয়কর বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামিট পাওয়ার লিমিটেড সুকৌশলে সামিট কর্পোরেশন লিমিটেডকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করেনি। এনবিআর থেকে বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করা হলেও তারা আমলে নেয়নি। অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য সামিট পাওয়ার এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। একই সঙ্গে সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে উৎসে কর কর্তন করেনি।
বিজ্ঞাপন
এনবিআর এখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে— বলেন ওই কর্মকর্তা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজারে জ্বালানি খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬৩.১৯ শতাংশের মালিক সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড। আয়কর আইন অনুযায়ী, শেয়ার হোল্ডিং মালিকদের লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো উৎসে কর কর্তন করেনি।
পুঁজিবাজারে জ্বালানি খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬৩.১৯ শতাংশের মালিক সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড। আয়কর আইন অনুযায়ী, শেয়ার হোল্ডিং মালিকদের লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো উৎসে কর কর্তন করেনি
২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে উৎসে কর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সামিট কর্পোরেশনের মোট শেয়ারের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
আয়কর আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কোনো কোম্পানিকে লভ্যাংশ উদ্ভূত হলে তার ওপর উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু সামিট কর্পোরেশন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ পরিশোধের সময় উৎসে কর কর্তন করেনি। পাঁচ কর-বছরে এতে উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সামিট পাওয়ার ও সামিট কর্পোরেশন মোট উৎসে কর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় এক হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এনবিআর সূত্রানুসারে, বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির বিশেষ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে সিআইসি। এনবিআরের এ গোয়েন্দা সেল বর্তমান সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনা এবং সুনির্দিষ্ট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য কর-ফাঁকিবাজদের তালিকা সম্পন্ন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের আয়কর ফাঁকির তথ্য অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি। যার ধারাবাহিকতায় সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার লিমিটেডের আয়কর ফাইল অনুসন্ধান করে ওই বিপুল পরিমাণ উৎসে কর ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।
আরও পড়ুন
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সামিট পাওয়ার লিমিটেডের শেয়ারের মধ্যে ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সামিট গ্রুপের আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড। বাকি ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আয়কর আইন- ২০২৩ এর ১১৭ ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত কোনো কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদানকালে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, সামিট পাওয়ার ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর কর্তন করেছে। কিন্তু সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ওপর উৎসে কর কর্তন করেনি।
অপরদিকে, এনবিআরের ২০১৩ সালের ১ জুলাই জারি করা আদেশ (এসআরও নং- ২১১) অনুযায়ী, করদাতা কোম্পানি সামিট পাওয়ার কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত হতে আয় (উৎপাদনের তারিখ হতে ১৫ বছর পর্যন্ত) এবং কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হতে উদ্ভূত মূলধনি আয় করমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের ওপর বাংলাদেশে আগমনের তারিখ হতে পরবর্তী তিন বছর, কোম্পানির নেওয়া বিদেশি ঋণের ওপর প্রদেয় সুদের ওপর এবং কোম্পানির প্রদেয় রয়ালিটি, টেকনিক্যাল সেবা ফি-এর ওপর কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কর অব্যাহতি নেই। এ ক্ষেত্রে লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর দিতে হবে।
অনুসন্ধান বলছে, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন এবং ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ কর-বছর পর্যন্ত (ছয় কর-বছর) কোম্পানির আয়কর রিটার্ন যাচাই করেছে। যেখানে দেখা গেছে, সামিট পাওয়ার ওই ছয় কর অর্থবছরে মোট লভ্যাংশ দিয়েছে এক হাজার ৯৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৯২১ টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৩৯৫ কোটি ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮৪ টাকা। মাত্র ৭৬ কোটি ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৩ টাকা উৎসে কর কর্তন করা হলেও বাকি ৩১৮ কোটি ৩৪ লাখ ৫ হাজার ২৩১ টাকা কর্তন করা হয়নি। সুদসহ এ উৎসে করের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ কোটি ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৫ টাকা।
আর এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, আয়কর অধ্যাদেশ- ১৯৮৪ এর ৫৪ ধারা অনুযায়ী, সামিট পাওয়ার ও সামিট কর্পোরেশন কর্তৃক লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ৫৬ (২) ধারা ও আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১১৯ (২) ধারায় সুবিধাভোগী অংশীদার হিসেবে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে প্রদেয় লভ্যাংশ হতে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না বলে স্পষ্টীকরণ করা হয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে প্রদেয় লভ্যাংশ হতে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে কোনো লভ্যাংশ প্রদান করা হয়নি। সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদান করা হয়েছে। ফলে আইনের ১১৭ ধারা অনুযায়ী, সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট কর্পোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশনকে দেওয়া লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর কর্তন করেনি। বিষয়টি নিয়ে ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর আবারও এনবিআর থেকে স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে।
সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড নিবন্ধিত করদাতা। এ কোম্পানির ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ সালের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী যাচাই ও বিশ্লেষণ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এতে দেখা গেছে, সামিট কর্পোরেশন ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট লভ্যাংশ ঘোষণা বা প্রদান করেছে দুই হাজার ৯১৭ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৪ টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৪৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এক টাকাও উৎসে কর কর্তন করেনি। সুদসহ এ উৎস কর দাঁড়িয়েছে ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৭ টাকা। অর্থাৎ সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশন এবং সামিট কর্পোরেশন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে মোট এক হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার উৎসে কর কর্তন না করে ফাঁকি দিয়েছে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামিট কর্পোরেশন লিমিটেড নিবন্ধিত করদাতা। এ কোম্পানির ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ সালের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী যাচাই ও বিশ্লেষণ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এতে দেখা গেছে, সামিট কর্পোরেশন ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট লভ্যাংশ ঘোষণা বা প্রদান করেছে দুই হাজার ৯১৭ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৪ টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৪৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এক টাকাও উৎসে কর কর্তন করেনি। সুদসহ এ উৎস কর দাঁড়িয়েছে ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৭ টাকা। অর্থাৎ সামিট পাওয়ার সামিট কর্পোরেশন এবং সামিট কর্পোরেশন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে মোট এক হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার উৎসে কর কর্তন না করে ফাঁকি দিয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সামিট কর্পোরেশনের মোট শেয়ারের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (সিঙ্গাপুরভিত্তিক অনাবাসী কোম্পানি)। বাকি শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আয়কর অধ্যাদেশ- ১৯৮৪ এর ধারা ১৮ (৩) ও আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২৭ (ঘ) অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি কর্তৃক বাংলাদেশের বাইরে পরিশোধিত কোনো লভ্যাংশ বাংলাদেশ উদ্ভূত হয়েছে বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর কর্তনের বিধান থাকা সত্ত্বেও এনবিআরের স্পষ্টীকরণের কারণে সামিট কর্পোরেশন কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া লভ্যাংশের ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করা হয়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের কোম্পানি সচিব স্বপন কুমার পালের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলেও কোনো জবাব মেলেনি।
আরএম/