তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তারা সহায়ক নীতির অভাব এবং ঋণ প্রাপ্তিতে কঠোর জামানত প্রক্রিয়া মুখোমুখি হচ্ছেন। তাই এ খাতের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা 

শনিবার (৯ নভেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিসিআই) আয়োজিত ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা উল্লেখ করেন।

সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে, যা সবাইকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তিনি বিদ্যমান নীতিমালাসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে নাগরিক সেবার পাশাপাশি ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরো সহজতর হবে এবং বর্তমান সরকার এ বিষয়টিকে অধিক হারে প্রাধান্য দিচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, রপ্তানি পরিসংখ্যান সহ অন্যান্য তথ্যে বেশ অসংগতি ছিল, যা নিরসনে বর্তমান সরকার বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, কারণ সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া কখনই যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যার কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যেখানে দেশের সকল স্তরের নাগরিকদের পাশাপাশি বিশেষকরে বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিবৃন্দ নিজেদের প্রত্যাশার প্রস্তাব পেশ  করতে পারে, যার ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম আরো জোরালো হবে।  

অনুষ্ঠানে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা, সফটওয়্যার এবং যন্ত্রপাতি সহ তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, তবে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও, আমাদের আয় ২.৫ বিলিয়ন ডলার, যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। 

সূচনা বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, এখাতে আমাদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চতর মূল্য সংযোজন পরিষেবা প্রদানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সেমিকন্ডাক্টর ভ্যালুচেইনে উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারিত করতে হবে। এছাড়াও পণ্যের ডিজাইন, অ্যাসেম্বলি প্যাকেজিং এবং টেস্টিং (এপিটি) প্রভৃতি খাতে আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে উদীয়মান আইওটি বাজারের জন্য ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের (আইডিএম) সুযোগগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। 

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, সফটওয়্যার ও পরিষেবা রপ্তানি ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এখাতে দক্ষতার ব্যবধান এবং পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। যা মেটাতে শিক্ষা, লজিস্টিক পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু উচ্চমানের মূল্য সংযোজন তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার পাশাপাশি গবেষণা, উন্নয়ন এবং রপ্তানি প্রণোদনার গুরুত্বের উপর জোর দেন।

বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, আমাদের তৈরি পোষাক শিল্পের পর তথ্যপ্রযুক্তি খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, যেখানে বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ সম্ভব।

তিনি বলেন, দেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের অনুমতি প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণের লক্ষ্যে বিডার পক্ষ হতে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ডিজিটাল কার্যক্রমের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, বিডা-এর ফ্রন্ট অফিসে একজন রিলেশনশিপ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, যার কাজ হবে সিঙ্গেল  ডেস্ক থেকে বিনিয়োগকারীদের সমস্ত পরিষেবা দ্রুত প্রদান করা।

বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

 তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২৬০০টিরও বেশি আইটি কোম্পানি কাজ করছে যা ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে এবং এখাতের বাজারের আকার ২.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি জানান, বর্তমানে ৪৫০টি বাংলাদেশি কোম্পানি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, সফটওয়্যার পরিষেবার সীমিত সুযোগের সাথে বাংলাদেশের ডিভাইস উৎপাদন ক্ষমতা নেই।

 তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আইটি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, রপ্তানি বাড়াতে তিনি স্থানীয় আইসিটি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে অফিস স্থাপনের অনুমতি দেওয়া এবং আইসিটি পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেন।আইসিটি উদ্যোক্তারা সহায়ক নীতির অভাব এবং ঋণ প্রাপ্তিতে কঠোর জামানত প্রক্রিয়া মুখোমুখি হচ্ছে। 

তিনি  উল্লেখ করেন, এখাতের বিকাশে পণ্যেও মেধাস্বত্ব অধিকারের সুরক্ষা অতীব জরুরি।

সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) মোহাম্মদ জাকির হাসান, বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান এবং ওয়ালটন ডিজি টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লিয়াকত আলী অংশগ্রহণ করেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) মোহাম্মদ জাকির হাসান বলেন, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। এখাতের অবকাঠামো উন্নয়ন এখনও আশানুরূপ নয়, যেখানে বেসরকারিখাতের বিনিয়োগে এগিয়ে আসার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। 

আর ওয়ালটন ডিজি টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লিয়াকত আলী বলেন, পরিচালক মো. লিয়াকত আলী বলেন, প্রতিযোগিতামূলক নীতির অভাবে আমরা দেশে এফডিআই আকৃষ্ট করতে পারছি না। তিনি আইটি ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য শুল্ক ও কর কাঠামো সংস্কারেরও অনুরোধ করেন। তিনি আরো বলেন, সেমিকন্ডাক্টর সেক্টরে বাংলাদেশের ভালো ডিজাইনের হাউস রয়েছে, তাই সরকারি ও বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ  বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার উৎপাদনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে।

আরএম/এমএ