•এখনই সময় এস আলমসহ রাঘববোয়ালদের ধরার
•খেলাপির সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে
•ব্যাংকের পর্ষদ করতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত
• হাসিনার আমলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা

আর্থিক খাতের বিষফোড়া খেলাপি ঋণ। এই ফোঁড়া নিরাম‌য়ে কার্যকর কো‌নো পদক্ষেপ নেয়নি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো নানা সু‌বিধা দি‌য়ে গে‌ছে। ফ‌লে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়‌ছে খেলাপি ঋণ।

সবশেষ ২০২৪ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বা ৩৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। সেই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হলো, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমানো। ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। কিন্তু খেলাপি না কমে উল্টো বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ উঠেছে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি হার প্রায় ৩৩ শতাংশে উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন ‘২৪ প্রান্তিকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩২ দশমকি ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ বা ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা এবং  বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থিতিশীল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের অঙ্ক এতো বড় দেখাচ্ছে এটা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বলা যায়। তবে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করতো তাহলে খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক আরো অনেক বেশি হতো। এছাড়া যে হিসাব দিয়েছে এখানে পুনঃতফসিল, পুনঃগঠন ও আদালতে স্থগিত করা খেলাপি ঋণের হিসাব নেই। এটি যোগ করলে অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। সেপ্টেম্বর থেকে ঋণ অনাদায়ি ৯০ দিন হলেই খেলাপি হবে, যা আগে ১৮০ দিন ছিল। তার মানে আগামীতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। 

২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের এ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের চিত্র

তিনি বলেন, এখন প্রথম কাজ করা দরকার দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের সঠিক হিসাব বের করা। কারণ সঠিক হিসাব জানতে পারলে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

খেলাপি ঋণ কমাতে কী পদক্ষেপ নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক— জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের পর্ষদ করতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। বিশেষ করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, যেমন এস আলম গ্রুপ, এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে যেসব জামানত আছে তা কীভাবে ব্যাংকের অনুকূলে নেওয়া যায় সে বিষয় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপিদের জামানতের বাইরে যেসব সম্পদ আছে তা কীভাবে জব্দ করা যায় তার কাঠামো তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনের দীর্ঘসূত্রিতা দূর করতে হবে। রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে এখন আর এসব বলা যাবে না। তাদের ধরতে হবে। পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তা সুবিধা নিয়ে খেলাপিদের ঋণ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। 

এসআই/এনএফ