পর্ষদ ভাঙা ঠেকাতে তড়িঘড়ি করে চেয়ারম্যান ও এক্সিকিউটিভ কমিটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই পরিবর্তিত পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে নতুন বোর্ড গঠন করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি। এর মাধ্যমে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলো ইউসিবি।  

মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংক এক আদেশে পর্ষদ বাতিল করেছে, একইসঙ্গে দুই শেয়ারহোল্ডার পরিচালকসহ তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো আদেশে বলা হয়, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।

গঠন করা নতুন পর্ষদের নিয়োগ পাওয়া দুইজন শেয়ারহোল্ডার হচ্ছেন শরীফ জহীর ও মো. তানভীর খান। এর মধ্যে শরীফ জহীর ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের পরিচালক এই পদ ছাড়ার শর্তে তিনি পরিচালক নিয়োগ পাবেন এবং ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স পরিচালক তানভীর খান পদ থেকে পদত্যাগের পর নিয়োগ পাবেন।  

ইউসিবির পর্ষদের নিয়োগ পাওয়া তিন স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসুফ আলী এবং চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ওবাইদুর রহমান।  

এর আগে মঙ্গলবার রোর্ড সভা করা করে ইউসিবি পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় স্বতন্ত্র পরিচালক ড. অপরূপ চৌধুরী আর এক্সিকিউটিভ কমিটি চেয়ারম্যান হন বশির আহমেদ। কিন্তু একদিন না যেতেই এ পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হলো।

ইউসিবি সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পিতা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।

২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপ ইউসিবির মালিকানা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপর থেকে ব্যাংকটিতে একক আধিপত্য বিস্তার করে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

এদিকে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন করে ব্যাংকের দেড় শতাধিকের বেশি শেয়ারহোল্ডার। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন। অপরদিকে, মালিকানা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছেন ইউসিবির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পারটেক্স গ্রুপের এম এ হাসেম পরিবার। এর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যানের বরাবর চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক খারাপ অবস্থার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে মালিকানা বদল চাওয়া হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ড. আহসান এইচ মনসুর। এরপর ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ দিন দখলে থাকা, সরকার পতনের পর মালিক পক্ষ পালিয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন তিন ব্যাংকের (ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক) পর্ষদ পুন:গঠন করা হয়েছে। আরো কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

এসআই/পিএইচ