৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটেছে। কিন্ত সরকারের সহচরদের দৌরাত্ম্য থে‌মে নেই। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। 

ন‌জিরবিহীন লুটপাট, ঋণ কে‌লেঙ্কা‌রি আর দখলদারিত্বের কারণে আজ দেশের ব্যাংকিং খাতের করুণ অবস্থা। এজন্য দায়ী করা হয় এস আলম, সালমান এফ রহমান ও তাদের দোসরদের। সেই গোষ্ঠীর সহযোগী ও ঘনিষ্ঠরা এখন ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) হওয়ার দৌড়ে আছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ডিজি পদ পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব নির্বাহী কর্মকর্তাদের নামের তালিকা আছে তাদের মধ্যে তিনজনই সাবেক গভর্নর তালুকদারের ঘনিষ্ঠ। যারা সরাসরি এস আলমের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। আবার রিজার্ভ চুরির তালিকাভুক্ত আসামি। এছাড়া তারা পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সহযোগী। তারা গত সরকারের আমলে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্প চালুর নামে জয়-পলককে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, যেসব কর্মকর্তা গত ১৫ বছরে দেশের আর্থিক খাতে বেপরোয়া হয়ে দেশের সম্পদ লুটে সহযোগিতা করছেন, তাদের বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বুধবার (২১ আগস্ট) এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন।

সেই চিঠিতে বলা হয়, সরকারের আমলে দেশের সম্পদ লুটেরাদের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সব আর্থিক অপকর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি। এছাড়া নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক রিজার্ভ চুরির তালিকাভুক্ত আসামি। একই সঙ্গে তিনি দুর্নীতির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়েরও ঘনিষ্ঠ মেজবাউল হক।

চিঠিতে আরও যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়

রিজার্ভ চুরি

রিজার্ভ চুরির পরে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কোনো ব্যক্তির পরামর্শে এক মাসের মতো গোপন রাখেন। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। তার পরামর্শে চুরি সংশ্লিষ্ট আইসিটি আলামত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে রাকেশ আস্তানাকে আইসিটি সিকিউরিটি এক্সপার্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চুরির আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়।

হাসিনাপুত্র জয়ের আইসিটি ব্যবসা 

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতের আইসিটি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন সজীব ওয়াজেদ জয়। ব্যবসায় সহযোগিতা করেছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক, তার ঘনিষ্ঠজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হক। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদ্ধতি বিশেষ করে পেমেন্ট সিস্টেমস ও সিআইবি বাণিজ্যিকিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষপূর্ণ। কিন্তু এসব কাজ বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এর অন্যতম উদাহরণ বিনিময় প্রকল্প। ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সুইস স্থাপনের জন্য জয়, দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের যোগসাজশে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকৃত খরচের চেয়ে ২০ গুণ অর্থ ব্যয় করে বিনিময় প্রকল্প শুরু করা হয়। এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ভেলওয়ার লিমিটেড সঙ্গে অর্ধেক লভ্যাংশ শেয়ারের জন্য একটি চুক্তি করা হয়।

ভারতের টাইম ইন্ডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে 'টাকা পে ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড' প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। জয়ের মালিকানাধীন হোম পে নামে প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভারতের যে কোনো এআইএম থেকে টাকা উত্তোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এনপিসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ডেটা সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের কাজ চলমান আছে।

জয়ের ব্যবসায়ীক ক্ষেত্র বৃদ্ধির জন্য দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের সব পদ্ধতি বেসরকারিকরণের জন্যে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছেন। তবে এবিষয়ে দাপ্তরিক কোনো সার্কুলার হয়নি।

নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) দেবদুলাল রায় 

দেবদুলাল ও আটক হওয়া প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় পলক দেবদুলাল ও মেজবাউল হককে জয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং সেক্টরের আইসিটিকে নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ক্রয় কাজে সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এছাড়াও জয়, দেবদুলাল ও মেজবাউল হক মিলে পেমেন্ট সিস্টেমস এবং আইসিটি বিভাগের সকল ক্রয় সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন আইসিটি পণ্যের উৎপাদক, ডিস্ট্রিবিউটর ও সরবরাহকারী মিলে এক অবিচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট করে ১ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করায়।

দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা সেন্টার বেসরকারি খাতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল আইসিটি সিস্টেমস কেনাকাটা দেব-দুলালের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। প্রকিউরমেন্ট সেকশনটি তার সহযোগী জনবল দিয়ে সাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেকশনের উপর থেকে নিচের সকল কর্মকর্তার তালিকায় আছে আইসিটি বিভাগের দুই পরিচালক । তারা হলেন- চন্দন সাহা ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। 

অতিরিক্ত পরিচালকদের মধ্যে বিষ্ণু পদ বিশ্বাস,  যুগ্ম পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল, উপপরিচালক মিথুন সরকারের সমন্বয়ে সাজিয়ে নিয়ে সকল অপকর্ম করে যাচ্ছেন দেবদুলাল।

ব্যাংক খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে 'সিআইবি'।  সিআইবিকে ব্যবসা ও চরম দুর্নীতি করার অভিলাষে বেসরকারি খাতে দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয় অযাচিতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট থেকে সার্কুলার করা হয়েছে। দেবদুলাল সিআইবি-সফটওয়্যারে সকল কন্ট্রোল নিয়ে কর্মকর্তাদের কর্মহীন করে রেখেছেন। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ তথ্য আপডেট করার ও সিস্টেমে তা নয় ছয় করার কন্ট্রোল দেব-দুলালের হাতে নিয়েছেনে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে চলমান সিবিএস ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টাটা কনসাল্টিং সার্ভিসেস (আইসিএস) থেকে ক্রয় করা। মেজবাউল হক এবং দেবদুলাল রায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এ কাজ করেছেন। গত ১৬ বছর ধরে এই সফটওয়্যার এর সার্ভিস চার্জের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনসাইট সার্ভিস দেওয়ার জন্যে ভারতীয়দের ব্যাংকের ভেতরে ওয়ার্ক ভিসা ছাড়াই কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এ সুবাদে বাংলাদেশের ফিন্যান্সিয়াল ডেটা ভারতের কাছে অবাধে চলে যাবার ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়নি। এই সফটওয়্যার বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিটি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তৈরির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেবদুলাল রায় নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) গত ১২ বছর ধরেও বাস্তবায়ন হতে দেননি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমকে পরোক্ষভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল রাখার অপচেষ্টা করেছেন তিনি।

নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম

বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম এস আলমের এজেন্ট, প্রচুর অবৈধ টাকার মালিক ও ব্যাংকের স্বার্থ বিরোধী কাজ করেছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে এ কর্মকর্তার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া দেবদুলাল, আনোয়ারুল ইসলাম ও মেজবাউল হককে ডেপুটি গভর্নর পদে পদোন্নতি না দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।  

এসআই/এসকেডি