অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দে‌খিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কো‌নও আয়ই হয়‌নি, আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে। ঘরের থালাবা‌টি বেচে কোরমা-পোলাও খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এভাবে আর কতদিন চলতে পারবে? আমানত শেষ হবে, গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না।

শনিবার (১৩ জুলাই) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

আর্থিক খাতে সবচেয়ে বে‌শি তথ‌্য লুকানো হচ্ছে অভিযোগ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের সবচেয়ে বে‌শি তথ‌্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে স‌ঠিক তথ্য সবচেয়ে বে‌শি জরুরি। বাংলাদেশ ব‌্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারবে না।

আর্থিক খাতের ক্লিনিং করতে হবে জা‌নিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের ব‌্যাংক খাতের সমস‌্যাগু‌লো সমাধান না করে জিইয়ে রাখছে। অর্থাৎ ঘরের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে রেখে দিচ্ছে। এতে করে কি আসলে দুর্গন্ধ দূর হবে? না, এটা আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে। ব্যাংককে মন্দ ঋণ, অনিয়ম, দুর্নী‌তি, অর্থ পাচার লু‌কিয়ে এ খাতের সমস‌্যা সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য আর্থিক খাতের ক্লি‌নিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়ী করতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্তু কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরাকার। আমরা তো আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরাকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকে যে এই অবস্থা হলো তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপ‌তিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। প্রবন্ধ উপস্থান করেন ইআরএফের জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবাইদুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব।

প্রবন্ধ উপস্থানকালে বলা হয়, পদ্মা সেতুসহ বি‌ভিন্ন অ‌বকাঠমো তৈ‌রি করে সরকা‌র যে প্রশংসা অর্জন করেছে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে উচ্চ মূল‌্যস্ফী‌তি ও ব‌্যাংক খাতের খেলা‌পি ঋণ ও নানা আর্থিক কেলেঙ্কা‌রিতে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে এ দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। এসব বিষয়ে এখনই য‌দি উদ্যোগ না নেওয়া হয় তবে বড় ধরনের সমস‌্যা সৃ‌ষ্টি হবে ব‌্যাংক খাতে।

প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪-৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আর ধরে রাখা যায়নি। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ২০২২ সালের আগস্টে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডিদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এরপর ব্যাংক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার বাজার আরও খারাপ হয়। ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার প্রভাবে টানা দু’বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আবার ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সঙ্কট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। 

বেনামি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভঙ্গুর অবস্থার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বর্তমানে শরীয়াহ ভিত্তিক ৫টিসহ ৭টি ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ তো দূরে থাক, দীর্ঘদিন ধরে চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চরছে। গত মে পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি হিসাব ঋণাত্বক রেখে কোনো ব্যাংক লেনদেন করতে পারার কথা না। অথচ ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উপায়ে লেনদেন করতে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি নতুন ঋণ বিতরণও অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে জুন ও ডিসেম্বর শেষে ঘাটতির চেয়ে বেশি জামানতবিহীন বিশেষ ধার দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতমুখী অবস্থান হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা। 

বর্তমান গভর্নর যোগদানের পরই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন ১০টি দুর্বল ব্যাংক আলাদাভাবে নিবিড় তদারকি করা হবে। এসব ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন করে কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে গত মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজে-কলমে এটা দেখানো হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নানা ছাড় দিয়ে কম দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বেশ আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বৃদ্ধি ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি গ্রহণ করে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে। বেশ আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের সুদহার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আউট অব বক্স’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। ওই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। তবে প্রায় দুই বছর পরও উন্নতি তো দূরে থাক, আরও অবনতি হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। যখন বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা বাংলাদেশের মান অবনমন করে দিয়েছে, তখন গর্ভনর বলেছেন, এটা রাজনৈতিক কারণে কমানো হয়েছে। 

অন্য দেশ যেখানে কঠোর নীতি থেকে সরে আসার অপেক্ষায় আছে, বাংলাদেশ সেখানে কঠোর নীতি গ্রহণ করে চলেছে। গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই দিন অর্থনীতির তিনটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইএমএফের চাপে পড়ে ওই দিন সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে, ডলারের দর ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর ঠিক করেছে এবং নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।

এসআই/পিএইচ