বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট কি না সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং (সানেম)।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত। আমরা মনে করি, সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বাজেটের আকার আরেকটু ছোট করা যেত।

শনিবার (৮ জুন) রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ জানাতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড সায়েমা হক বিদিশা।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা এবারও রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। বাজেটের ঘাটতিকে আরও কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন কমিয়ে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রক্ষা করার সুযোগ ছিল। মূল্য সংযোজন কর আরও কমানো যেত। মূসক একটি পরোক্ষ কর যার চাপ সবার উপরে সমানভাবে পড়ে। এটা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের জালের আওতা বৃদ্ধি করে সেই ঘাটতি পূরণ করার সুযোগ ছিল। প্রতি বছরই আমরা লক্ষ্য করছি, কর হারের দিকে যতটা নজর দেওয়া হচ্ছে, কর জালের আওতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ততটা নজর দেওয়া হচ্ছে না। সে কারণেই প্রতি বছর দেখা যাচ্ছে, বাজেটের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থায়ন করা হচ্ছে যার নেতিবাচক প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর পড়ছে। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পদক্ষেপ মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত, যা আমরা এই বাজেটে দেখিনি। সার্বিকভাবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ আমরা বাজেটে দেখিনি।

সায়েমা হক বিদিশা বলেন, বর্তমানে অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে সবার আগে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নেতিবাচক প্রবণতা ও সার্বিকভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য কমানো এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার চ্যালেঞ্জও আমাদের সামনে রয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসাটা মুখ্য চ্যালেঞ্জ। গত কয়েক মাস ধরে টানা মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন আমরা দেখছি। গত বছরের তুলনায় বাজেটের হার ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। বাজেটের আকার ও ঘাটতি কিছুটা ছোট রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কিছু জায়গায় কৃচ্ছ্রতাসাধনের চেষ্টা আমরা দেখেছি। একটি ভালো উদ্যোগ হচ্ছে, ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে উৎস কর কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে কমিয়ে আনা হয়েছে। যার কিছুটা সুফল দেখতে পারব বলে আমরা আশা করছি। এর বাইরে ফ্যামিলি কার্ড, রেশন, ওএমএস প্রোগ্রামের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সানেমের গবেষণা পরিচালক বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন কমে ২৫ বিলিয়ন ডলার মতো রয়েছে। যা বিভিন্ন দায় বিবেচনা করলে ২০ বিলিয়ন ডলারের কম। এই রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম যে ধরে রাখা হয়েছিল তার প্রভাব বাজারে ভালো হয়নি। এখন হঠাৎ করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতি চাপে পড়েছে। এক্ষেত্রে গত বাজেটে যা ছিল তারই একটি ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি।

রপ্তানিতে আমরা যেসব প্রণোদনা দেই তা আরও বিচার-বিবেচনা করে দেওয়া জরুরি। কোন কোন রপ্তানি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে তা বিবেচনায় রাখা উচিত। কেননা আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা করার সার্বিক পরিবেশ জড়িত। বৈদেশিক বিনিয়োগে আমরা বড় ধরনের কোনো উল্লম্ফন দেখছি না। সেই জায়গায় কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল যা প্রস্তাবিত বাজেটে আমরা দেখছি না। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে, যতক্ষণ পর্যন্ত খোলা বাজারের সঙ্গে ব্যাংক রেটের পার্থক্য থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত হুন্ডির প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকবেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য হুন্ডি ও কালো টাকার সার্কুলেশনের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে ড বিদিশা বলেন, পদক্ষেপটি আমাদের অর্থনীতির দর্শনের নীতিবিরুদ্ধ। এ পদক্ষেপের কারণে যারা সৎভাবে ব্যবসা করবে, তারা নিরুৎসাহিত হবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচলিত যেই পদ্ধতি অর্থাৎ মুদ্রানীতি, সেটি মূল্যস্ফীতি কমাতে সম্পূর্ণ কার্যকর হচ্ছে না। যে মুহূর্তে উপলব্ধি হলো যে নির্দিষ্ট সুদের হার অর্থাৎ ৬-৯ নীতি কার্যকর নয় তখন চেষ্টা করা হলো বাজারভিত্তিক সুদের হার নেওয়ার। তারপরও এই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না কেন? এটির একটি কারণ হচ্ছে নীতিটি অনেক বেশি দেরি করে নেওয়া হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের মূল কারণ হলো সার্বিক চাহিদা কমিয়ে আনা। তবে দেরি করে নীতি নেওয়ার কারণ তা অনেকটা কমে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে আরও বেশি সুদের হারের পরিবর্তন করলে আর্থিক খাতে ধ্বস নামবে। সুতরাং সঠিক সময়ে নীতি না নেওয়ায় এই সুদের হার বাড়ানো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। আরেকটি প্রশ্ন রয়ে যায়, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য যা করা হয়েছে তা কতটা বাস্তবসম্মত? আমাদের আর্থিক ও মুদ্রা নীতির সমন্বয়ের সমস্যা রয়েছে। বাজারে হঠাৎ করে অযৌক্তিক দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ রকম প্রতিযোগিতা বিরোধী কাজের পরেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

সানেমের পক্ষ থেকে আমরা প্রস্তাব করছি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ২ বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থাকা দরকার, যাতে ব্যবসার আস্থা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা বাড়ে। এছাড়াও ব্যাংকে আমরা যারা ডিপোজিট করছি তারা যেন আস্থা ফিরে পাই। এছাড়াও দুর্নীতির ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত এবং সংসদীয় কমিটি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দুর্নীতির বোঝা বহন করতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। দুর্নীতির জায়গায় আমরা জিরো টলারেন্স দেখতে চাই।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রসঙ্গে সেলিম রায়হান বলেন, ক্রলিং পেগকে আরও নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিতে হবে। যদি প্রশাসনিক এক্সচেঞ্জ রেট রেখে দেওয়া হয় বা ব্যান্ডটি পরিষ্কার না করা হয়, সেক্ষেত্রে আস্তে আস্তে বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেটের দিকে যেতে হবে। যত দেরি হবে, তত বেশি ধাক্কা খেতে হবে অর্থনীতিকে। তাই আমরা জানতে চাই, ক্রলিং পেগ ঠিক কতটুকু ক্রল করতে পারে? কালো টাকা সাদাকরণের চেয়েও কীভাবে কালো টাকা হচ্ছে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১ বছর আগের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে এই উদ্বেগের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর বোঝা বেড়েই চলেছে। মোবাইল এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, এটির উপর কর বাড়ানোতে নিম্ন আয়ের মানুষের উপর বোঝা বেশি পড়বে। অন্যদিকে, ধনীদের একটা বড় অংশ করের আওতার বাইরে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইসরাত হোসাইন, ইশরাত শারমিন, আফিয়া মুবাশশিরা তিয়াশা, গবেষণা সহযোগী খন্দকার ইফফা, সাফা তাসনিম ও গবেষণা সহকারী নাফিসা জামান।

এমএইচএন/এসকেডি