জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সংবাদ সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (৭ জুন) দুপুর ৩টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।

এতে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব) আব্দুস সালাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বাণিজ্যমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অংশ নেন।

সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার।

বা‌জেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে শুরুতেই সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকা‌শে বাধার প্রতিবা‌দে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদা‌রের বক্তব্য বয়কট করেন অর্থনী‌তি বি‌টের সাংবা‌দিকরা।

পরবর্তী পর্বে এক প্রশ্নের উত্তরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আরও ৬ মাস অপেক্ষা করতে বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, এই বছরের শেষের দিকে এটি কমতে শুরু করবে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন বাজেটের আকার আমরা কমিয়ে রেখেছি। যাতে করে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো চাপ না পড়ে।

পরে আরেক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাদের বৈধ সম্পদ রিটার্ন দাখিলের সময় দেখাতে পারছেন না। সে কারণে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাদের বৈধ সম্পদ দেখাতে পারছেন না, সে কারণে আমরা এই সুযোগটা দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, কালো টাকা যারা তৈরি করেন তারা ইকোনমিকে ব্যবহার করার জন্য তৈরি করেন না। কালো টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। কালো টাকাটা ভোগ বিলাসের জন্য তৈরি করা হয়। জমি ক্রয়-বিক্রয় করার সময় কিছু টাকা কালো হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে যারা রিটার্নে যেসব সম্পদ দেখাতে পারেননি, সেই সম্পদ দেখানোর জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যা অনেক দেশেও দেওয়া হয়ে থাকে।

এসময় সাংবাদিকরা পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের কি হবে সে ব্যাপারে জানতে চান। এ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, কাগজের খবর অনুযায়ী উনি বাইরে আছেন। উনি সময় চেয়েছেন, দুদক সময় দিয়েছে। আপনারা কাগজে দেখেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধান শেষে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, দুদক সমন দিয়েছিল। কাগজের খবর অনুযায়ী উনি বাইরে আছেন। উনি সময় চেয়েছেন, দুদক সময় দিয়েছে। তথ্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটা শেষ করতে দিতে হবে। তারপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ পর্যন্ত কেউ বলে নাই যে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগাম করে কেউ বলেও নাই তাকে জেলে দেবো, ফাঁসি দেবো; সেটাও সঠিক নয়। যতই অপরাধ করুক, সে বাংলাদেশের নাগরিক তো। নাগরিক হিসেবে তার যে অধিকার আছে, সেটা তো থাকবে। বিচার ব্যবস্থাই এটি সম্পন্ন করবে।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, বেনজীরের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিলে তার (বেনজীর) কালো টাকা সাদা হবে কিনা সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় জানা যাবে।

অপর আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ২০২৫ সালের পর সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে হবে।

এসময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ করে সংস্কার করা হবে না। প্রত্যেকটা ব্যাংক চালু রেখেই ব্যাংকগুলো সংস্কার করা হবে।

ড. মসিউর রহমান আরও বলেন, ব্যাংকে মানুষ টাকা জমা রাখছে। ব্যাংক সেজন্য সুদ দেয়। ব্যাংক যদি সেই টাকাটা কোথাও বিনিয়োগ করতে না পারে, তাহলে ব্যাংক তো বন্ধ হবে। ব্যাংক বন্ধ করা কোনো সরকারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংকের পারফরমেন্স ও নন পারফরমেন্স লোনের অংকটা একদিনের নয় এবং এগুলো বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখা এবং ব্যাংকের সুস্থ পরিচালনা করা; এই দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার এ বিষয়ে সচেতন।

তবে এসময় বাজেট নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত অর্থমন্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে উল্টো সাংবাদিকদের মান নিয়ে প্রশ্ন করেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের বিষয়ে যে পর্যায়ের প্রশ্ন আশা করেছিলাম সেরকম হয়নি। তবে বেশ কয়েকজনের প্রশ্ন বেশ ভালো ছিল। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা একেবারেই নন-সিরিয়াস প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যোগ্য না আমি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি একটু ম্যাচিউরড প্রশ্ন আশা করেছিলাম। আমি খুবই নিরাশ হয়েছি। আপনারা (সাংবাদিকরা) আরো একটু পড়ে আসবেন। এভাবে অতি সরলীকরণ করবেন না। একটু ম্যাচুউরিটি নিয়ে আসেন।

যারা আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে— জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো খোলাখুলি সব বলেছি। কোনো রাখঢাক করিনি। আপনি ঘুরেফিরে একই কথায় যাচ্ছেন কেন? এইটা তো বুঝতে পারলাম না। এটা কী ধরনের প্রশ্ন! কীভাবে প্রশ্ন করে এগুলো একটু শিখতে হবে তো। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এটা কোনো জার্নালিজম না। খালি এক কথাই ঘুরে ফিরে বলেন। এগুলো একটু দেখেন। দেখে একটু শেখেন। তাহলে আমাদেরও কাজ করতে সুবিধা হবে।’

এর আগে গতকাল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অংকের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত ও অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে। যদিও গত ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঠিক করেছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটের এ আকার কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।

আরএইচটি/এসআর/এমএইচএন/এসআই/এমএসআই/পিএইচ