আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বাহারি গ্রীষ্মকালীন ফলে বাজার ভরপুর। বাজারে ফলের ডালি সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। তবে মৌসুমের শুরুতে এসব ফল বিক্রি হচ্ছে কিছুটা চড়া দামে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্য ফলের তুলনায় ক্রেতাদের নজর কাড়ছে হিমসাগর, গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগসহ আরও বেশ কয়েক জাতের আম। মৌসুমের শুরুর দিকে হওয়ায় খুচরা বাজারে এসব ফল বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৮০ টাকায়। দাম নিয়ে ক্রেতাদের অসন্তোষ থাকলেও হাসিমুখে কিনছেন আমপ্রেমিরা।

শনিবার (১ জুন) রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা এলাকার একাধিক ফলের বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে, আম-লিচুসহ মৌসুমি ফলের চাহিদা বাড়ায় কমতে শুরু করেছে অন্য ফলের দাম। বাজারে প্রতি কেজি সবুজ আপেল ২৭০ টাকায়, লাল আপেল ২৩০ টাকায়, মাল্টা ২০০ থেকে ২৩০ টাকায়, কমলা ৩৫০ টাকায় ও আঙ্গুর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ফল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সবচেয়ে ভালো আমের মধ্যে রয়েছে গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, ক্ষীরশাপাতি ও ল্যাংড়া। হাটে গোপালভোগ আম আসা শুরু হয়েছে। এখনো লক্ষ্মণভোগ, ক্ষীরশাপাতি ও ল্যাংড়া আম আসা বাকি। এবার তুলনামূলক ফলন কম হলেও দাম ভালো পাচ্ছেন চাষিরা। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিক্রেতারা। তাদের দাবি, ঝড়বৃষ্টিতে সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফলের দাম বেড়েছে।

দাম বেশি, তাই আম খাওয়া কমে যেতে পারে আমিরুলের

রামপুরা বাজারে একাধিক ফলের দোকান ঘুরে আম দেখছিলেন আমিরুল হক নামের এক ক্রেতা। তিনি বলেন, আমের সিজনে শুধু আমটাই খাই। এসময়ে অন্য কোনো ফল খুব বেশি খাই না। একদিন ঘরে আম না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তবে এবার মনে হয় তৃপ্তি মিটিয়ে আম খাওয়া হবে না। গত বছরও যেখানে একসঙ্গে ৮ থেকে ১০ কেজি করে আম কিনে বাসায় নিয়েছি, এ বছর সেখানে কয়েকটা দোকান ঘুরে ৪ কেজি নিয়েছি।

আমিরুল হক বলেন, ১৩০-১৪০ টাকার নিচে যেগুলো আছে, সেগুলো দেশি আম। এগুলো টক জাতীয় হয়, তাই খুব বেশি খাওয়া যায় না। ভালোটা নিতে গেলেই ১৪০-১৫০ টাকা, যেগুলোর কেজি গত বছর এসময়ে ৭০-৮০ টাকা ছিল। সবমিলিয়ে এ বছর আমের দামটা অনেক বেশিই মনে হচ্ছে।

মধ্যবাড্ডা এলাকায় ফারুক আহমেদ নামের আরেক ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমের সিজন তো মাত্র শুরু হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দামটা একটু বেশি। তারপরও প্রতিদিনই নিচ্ছি, খাচ্ছি। বাচ্চারা আম খুব পছন্দ করে। আমার নিজেরও বেশি পছন্দের ফল আম, তাই দামটা খুব বেশি আমাদের প্রভাবিত করতে পারে না। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে আম সবার হাতের নাগালে আসবে, তখন সবাই কিনতে পারবে।

‘সিজন মাত্র শুরু, তাই দামটা একটু বেশি’

আম বিক্রেতা আরমান বলেন, পাকা আমের সিজন শুরু হয়ে গেছে, তবে আরও কিছু জাতের আম আছে যেগুলো আসতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। এখন গোপালভোগ, হিমসাগরসহ বেশ কিছু আম বাজারে এসেছে। আম্রপাল, ল্যাংড়াসহ বেশকিছু আম এখনো বাজারে আসা শুরু করেনি। তবে যেই পরিমাণ আম আসছে তার তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই, সব ধরনের মানুষই আম নিচ্ছে।

তিনি বলেন, কেবল আমের সিজন শুরু হয়েছে, তাই দামটা একটু বেশি। বর্তমানে প্রকারভেদে ১২০ থেকে শুরু ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি করছি।

দাম প্রসঙ্গে এই বিক্রেতা বলেন, এ বছর অনেক গরম পড়েছে, যার কারণে আম গাছ থেকে ঝরে গেছে। মুকুল আসা থেকে শুরু করে আম পাড়া পর্যন্ত গরম পড়েছে এবার। এজন্য ফলন অনেকটা কম। আবার ঘূর্ণিঝড়েও প্রচুর আম নষ্ট হয়েছে। তারপরও আশা করছি সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমের দাম আরেকটু হাতের নাগালে চলে আসবে।

কোন আমের চাহিদা বেশি– জানতে চাইলে খোকন মিয়া নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, সবচেয়ে মজার আম হিমসাগর। এই আম সাইজে বড়, ৪ থেকে ৫টা আমেই এক কেজি হয়ে যায়। হিমসাগরকে তো আমের রাজা বলা হয়। এছাড়াও ক্ষীরশাপাত, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ আমও বেশ মজার। এগুলোরও চাহিদা আছে।

কোন আমের সিজন কখন?

ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ১৫ মে থেকে সব ধরনের গুটি আম নামিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। ২৫ মে গোপালভোগ আম বাজারে এসেছে। ওইদিন রানিপছন্দ আসার কথা থাকলেও পরিপক্ব হয়নি। এরপর লক্ষ্মণভোগ বা লখনা ৩০ মে এবং একই তারিখে হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি গাছ থেকে পাড়ার কথা।

এ ছাড়া ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া ও ব্যানানা আম; ১৫ জুন আম্রপালি এবং একই তারিখে ফজলি; ৫ জুলাই বারি-৪ আম; ১০ জুলাই আশ্বিনা; ১৫ জুলাই গৌড়মতি এবং ২০ আগস্ট থেকে ইলামতি আম পাড়া যাবে। তবে এ তারিখের আগেও চাষিরা স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়ে আম পরিপক্ব হওয়ার শর্তে পাড়তে পারবেন। এর বাইরে বারোমাসি কাটিমন ও বারি-১১ আম সারা বছর সংগ্রহ করা যাবে।

দেশে আমের বাজার

দেশে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাজার রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যদিও গত বছরের তুলনায় এ বছর আমের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে আমের উৎপাদন ২৭ লাখ টনের মতো। প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়। আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, মোড়কীকরণ ও পরিবহন মিলিয়ে এ বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর এপ্রিলে কাঁচা আম বাজারে আসা থেকে শুরু হয় এ বাণিজ্য। চলে সেপ্টেম্বরে আশ্বিনা আম বিপণন শেষ হওয়া পর্যন্ত। আম পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদন পর্যায়ে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার না করায় আমের ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ২৯ টন, রপ্তানি হয় ৩১০ টন। এসময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৮ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৬৮ টন, রপ্তানি হয়েছিল ২৮৩ টন। এসময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ টন, রপ্তানি হয়েছিল ৭৯১ টন। এসময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৯৮ লাখ হেক্টর জমিতে।

দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ টন, রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ টন। এসময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৮ লাখ হেক্টর জমিতে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৭ টন, রপ্তানি হয়েছে ৩১০০ টন। এসময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৫ লাখ হেক্টর জমিতে। তবে এ বছর গত অর্থবছরের থেকে উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমতে পারে।

টিআই/এসএসএইচ