তিন মাস আগে পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পাননি খাইরুল ইসলাম। দফায় দফায় নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাত্র দুই লাখ ৯৫ হাজার টাকা দিতেই যদি এমন টালবাহানা করে তাহলে ব্যাংকের ওপর কীভাবে বিশ্বাস রাখি— এমন অভিযোগ খাইরুল ইসলামের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনদিন গভীর হচ্ছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের তারল্য সংকট। মফস্বলের পর এবার রাজধানীর শাখাতেও আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। খাইরুল ইসলাম নয়াপল্টনে অবস্থিত ব্যাংকটির ভিআইপি রোড শাখার গ্রাহক।

ইতালি প্রবাসী আফসার উদ্দিন মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখায় এক মাসে তিনবার এসেও দীর্ঘদিন থেকে জমানো সঞ্চয় ফেরত পাননি। এমনকি এ শাখার ম্যানেজারকেও খুঁজে পাচ্ছেন না এ গ্রাহক।

আফসার উদ্দিন বলেন, আমি ১৯৮৮ সালের পর থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি। এর আগে আমি কুয়েতে থাকতাম, বর্তমানে ইতালি থাকি। এ ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় আট লাখ টাকা রয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে তিনবার এসেছি, তবে এখনও টাকা তুলতে পারিনি।

‘ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে’— জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা পাব— এমনটি বলা হচ্ছে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকে ঝামেলা চলছে বলেও কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। আবার প্রধান কার্যালয়েও যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। আমি যতবার এসেছি কখনও এ শাখার ম্যানেজারকে পাইনি। যখনই আসি তখনই বলা হয়, ম্যানেজার বাইরে চলে গেছেন।’

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মতিঝিল শাখার আরেকজন গ্রাহক শিবলী মাহমুদ। তিনি বলেন, এ ব্যাংকে দুই বছর আগে তিন লাখ টাকা রেখেছিলাম। হঠাৎ শুনছি, ব্যাংকটি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। গত ১৫ দিন আগে এসেছিলাম টাকা তুলতে। ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল কয়েকদিন পরে আসার জন্য। এরপর আজ এসেছি। আজও টাকা দিতে পারল না, আজও আশ্বাস দিল।

জানা যায়, ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়ে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চায় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। ফলে আবেদনের দুই সপ্তাহ পরে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ, এটি তারল্য সংকটের কারণে কার্যত বন্ধ রয়েছে।

গত সপ্তাহে ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখার গ্রাহক, জেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ছড়াকার কবি আব্দুল হামিদ মাহবুব টাকা তুলতে গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ওই শাখায় তার এক লাখ টাকা জমা রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য চেক নিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে দেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে তাকে জানানো হয় যে, ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তিনি ওই চেকের ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।

একই পরিস্থিতি ঢাকার নয়াপল্টন ও কারওয়ান বাজার শাখায়ও। শাখা দুটিতে টাকা তোলার জন্য আসা আমানতকারীদের ফেরত যেতে হচ্ছে খালি হাতে।

তারল্য সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ বলেন, আমরা আগে কখনও এমন সংকটে পড়িনি। সব আমানতকারী একই সময়ে আমানত নিতে আসছেন। ফলে আমরা তাদের আমানত ফেরত দিতে পারছি না।

‘গত পাঁচ মাসে আমরা আমানতকারীদের ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। ইতোমধ্যে ঋণের বিপরীতে রাখা জামানত বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা আবার গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনও সাড়া পাইনি। কারণ, আমাদের কাছে জামানত হিসেবে কোনো তরল সম্পদ নেই।’

‌ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ‌ব‌্যাংকের চিহ্নিত করা দুর্বল ব্যাংকের তালিকায় অন্যতম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মোট ঋণের ৮৬ দশমিক ৯১ শতাংশই খেলাপি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৮৭ কোটি টাকা।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক রাখা হয়। ২০২২ সালের শেষে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল এক হাজার ২১২ কোটি টাকা।

এসআই/