ব্যাংক ঋণের সুদের হার নিয়ে ‘নয়-ছয়’ থেকে ‘স্মার্ট’—কোনো পদ্ধতিতেই স্থির থাকতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি সুদহার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয় তারা। কিন্তু তা কার্যকরের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আজ স্বাধীন সুদহারে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা ১৪ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখা হবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।  

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দে‌শের সমসাম‌য়িক অর্থনৈ‌তিক প‌রি‌স্থিত নি‌য়ে ব‌্যবসায়ীদের স‌ঙ্গে বৈঠক ক‌রেন গভর্নর। এ সময় গভর্নর সুদহা‌রের বিষয়ে নতুন নীতি কী হবে সে বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। 

বৈঠক শেষে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম সাংবাদিকদের জানান, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির ঘন ঘন এসব নীতি পরিবর্তনের কারণে ব্যাবসায়িক পরিকল্পনায় বিপত্তি তৈরি হচ্ছে। একটা ব্যবসা করার সময় সুদের হার, বিনিময় হারসহ নানাবিধ চিন্তাভাবনা করেই কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক অল্প সময় পরপর নীতিতে পরিবর্তন আনছে। এভাবে বারবার নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগুলো বারবার পরিবর্তন না করে দীর্ঘমেয়াদি করার কথা বলেছি। এতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে। গভর্নর এ বিষয়ে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ঠেকাতে সুদের হার ভবিষ্যতে ১৪ শতাংশের মধ্য আটকে দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন গভর্নর।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত ৮ মে ব্যাংকঋণের সুদহার ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি  (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) প্রত্যাহার করা হয়। ব্যাংকঋণের সুদহার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার মানে এখন থেকে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে।

গত ১০ জুলাই স্মার্ট সুদের হার পদ্ধতি চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর আগে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল ঋণ এবং আমানতের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা যথাক্রমে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই সুদের হার ক্ষেত্র বিশেষে ১৪ থেকে ১৯ শতাংশেও ওঠে।

এখন বাজারভিত্তিক সুদহারের নির্দেশনা থেকেও পিছু হটতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ডলারের দাম একসঙ্গে ৭ টাকা বাড়ার কারণে যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে সে পরিমাণ অর্থ সংস্থান করতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের আবেদন করেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ ডলারের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া যাদের একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার মার্কেট স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্তা।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছি না। এদিকে ইডিএফ কমিয়ে তিন বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এই সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প একটি তহবিল ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এখন ব্যবসায়ীরা ১১৭ টাকায় এলসি খুলতে পারছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু কিছু গ্রাহকের একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে। বিষয়টি সমাধানে ব্যাংক এবং গ্রাহক ভিত্তিক বিশেষ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গভর্নর। ফান্ডেড এবং নন ফান্ডেড মিলে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একজন গ্রাহক না পাওয়ার শর্ত থাকলেও এই পরিস্থিতিতে তাদের জন্য বিশেষ বিবেচনা করা হবে।

এদিকে গতকাল (বুধবার) এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব গ্রাহকের নির্ধারিত একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছিল, তাদের ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরপরও কিছু গ্রাহক একক গ্রাহক ঋণের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার জন্য আবেদন করছেন, যা নির্দেশনার পরিপন্থি। এমন প্রেক্ষাপটে বৃহৎ ঋণঝুঁকি হ্রাস, করপোরেট সুশাসন সমুন্নত রাখা এবং ঋণ বিতরণে উত্তম চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একক গ্রাহক ঋণ সীমা কোনোক্রমেই অতিক্রম না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু আজ ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে সেই নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবেন না বলে জানিয়েছেন গভর্নর।

দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন-বিজিএমইএর সভাপতি এম মান্নান কচি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিনিয়োগ অঞ্চল ছাড়া কোথাও ব্যাংকগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারবে না বলে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন ভুল প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করার আাহ্বান জানানো হয়েছে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হয়নি। কিছুক্ষেত্রে জায়গাও এখনো ঠিক হয়নি। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ছোট ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করার সক্ষমতা নেই। তাহলে তারা কীভাবে বিনিয়োগ করবে, কোথায় বিনিয়োগ করবে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ছাড়াই প্রজ্ঞাপন দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্ত।

এসআই/এমএ