দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং অধিক পরিমাণ কর প্রদানে উৎসাহ দিতে উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত কর্পোরেট কর ছাড় দিতে যাচ্ছে সরকার। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কোম্পানির কর হার আড়াই শতাংশ কামানো হতে পারে।

অন্যদিকে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী বিবেচনায় ভোগ্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে যথাসম্ভব করছাড় দেওয়া হবে। পাশাপাশি ২৭ ডিজিটাল সেবায় কর অব্যাহতির মেয়াদ আরো দুই এক বছর রাখার পক্ষে মতামত এসেছে।

রোববার (১২মে) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ওইসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে।

বাজেটে যেসব বিষয় পরিবর্তন করার পক্ষে আলোচনা হয়েছে, তার বেশিরভাগের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী একমত হয়েছেন। ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নাম প্রকাশ না করে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্পোরেট কর কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কেবল উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজার তালিকা বহির্ভূত কোম্পানি ওই ছাড়ের আওতায় আসবে। বর্তমানে এসব কোম্পানির করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ। শর্ত সাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কমে ২৫ শতাংশ হতে পারে। কোম্পানিকে কর প্রদানে উৎসাহ দেওয়া, কর প্রদানে স্বচ্ছতা বাড়তে এই করহার কমানো হবে। তবে অন্যান্য কর্পোরেট কর অপরিবর্তিত থাকবে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শর্ত সাপেক্ষে কর্পোরেট কর কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর্পোরেট কর ছিল ৩৫ শতাংশ। তা থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ৩০ শতাংশ করা হয়েছিল।

যদিও কর্পোরেট কর ছাড়ের সুবিধা পেতে দুইটি শর্ত মানতে হয়। প্রথমত; সব ধরনের আয় ও প্রাপ্তি এবং ৫ লাখ টাকার বেশি একক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত; বছরে ৩৬ লাখ টাকার বেশি ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ কোম্পানির কর হবে ৩০ শতাংশ।

যদিও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, গত কয়েক অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু শর্তের কারণে ব্যবসায়ীদের অনেকেই কমানো করহারের পুরো সুবিধা নিতে পারছেন না। সেজন্য শর্ত পরিহার করে কার্যকরী কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত,বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ছেড়েছে, সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে কর্পোরেট করহার ২০ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানি আইপিওতে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কর্পোরেট করহার সাড়ে ২২ শতাংশ। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির কর্পোরেট করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ। একক ব্যক্তির কোম্পানির ক্ষেত্রে কর্পোরেট করহার নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ২২ শতাংশ।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে বর্তমানে কর্পোরেট করহার নির্ধারিত রয়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। যেসব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, তাদের ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর ৪০ শতাংশ। এর বাইরে তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর ৪০ শতাংশ। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট কর নির্ধারিত রয়েছে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে, এ হার ৪৫ শতাংশ। এ ধরনের কোম্পানিকে কর্পোরেট করের পাশাপাশি আড়াই শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হয়।

অন্যদিকে ভোগ্যপণ্য কর ছাড় প্রসঙ্গে একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ভোগ্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানি ও তা দিয়ে তৈরি পণ্যের খরচ বাড়বে। এতে মানুষের উপর ছাপ বাড়বে। সেজন্য ভোগ্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে যথাসম্ভব করছাড় দেওয়ার পক্ষে সায় দিয়েছেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।  আর ২৭ ডিজিটাল সেবায় কর অব্যাহতির মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে। আইএমএফ ছাড়ের বিপক্ষে। তবে সরকার প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে চায়, সেই বিবেচনায় ওই সেবায় অব্যাহতি আরও দুই এক বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালে দেশের পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। এরপর থেকে বিনিয়োগকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে বাজারমুখী করা এবং নতুন প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনতে কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা সীমিত ছিল। ২০১৫ সাল থেকে কর সুবিধা আরও বাড়ানো হয়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

অর্থাৎ ধসের পর থেকে হিসাব করলে ২৪ বছর, আর ২০১৫ থেকে হিসাব করলে ৯ বছর এই সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর সুবিধা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভোগ করতে পারেন না। মূলত বাজার অস্থিতিশীল বা বাজারে ধস নামার সঙ্গে জড়িত ফটকা বিনিয়োগকারীরা। সেজন্য আগামী বাজেটে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা কোথাও কোথাও কমিয়ে আনা, আবার কোথাও কোথাও তুলে নেওয়া হতে পারে। পুঁজিবাজার থেকে করছাড় কমিয়ে আনতে আইএমএফ ইতোমধ্যে এনবিআরকে পরামর্শ দিয়েছে।

এছাড়া করদাতারে হয়রানি কমাতে সব শ্রেণির করদাতাদের স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা কমানো হতে পারে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

আরএম/এসকেডি