ন্যাশনাল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কী
ভেঙে দিয়েছে পর্ষদ, আতঙ্কে আমানতকারীরা
ঋণে নানা ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, অর্থ লুটপাট, পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ; সবশেষ সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব— এসব কারণে দেশের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকের মনে প্রশ্ন, কী হবে ব্যাংকটির। জমানো অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কায় আছেন তারা। কেউ কেউ আবার টাকা তুলে নিচ্ছেন।
ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পর প্রথম কর্মদিবস রোববার ন্যাশনাল ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গিয়ে দেখা যায়, অনেক আমানতকারী টাকা তুলার জন্য এসেছেন। অনেকে এসে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে আসছে। বিশাল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে তারল্য সংকট। সবমিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক। বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির। যদিও নতুন বোর্ড গঠন করা হয়েছে, কিন্তু তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, এটাও দেখার বিষয়
বিষয়টি স্বীকারও করেছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের দিলকুশা শাখার এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার খবর শুনে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন। টাকা উঠাতে অনেকে ভিড় করছেন।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে আসছে। বিশাল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে তারল্য সংকট। সবমিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক। বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির। যদিও নতুন বোর্ড গঠন করা হয়েছে, কিন্তু তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, এটাও দেখার বিষয়। তবে, দেরিতে হলেও পর্ষদ ভাঙার সিদ্ধান্ত ভালো হয়েছে। অনিয়মের প্রশ্রয় দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন।
জানা যায়, অনিয়ম এবং পর্ষদের পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতায় আর্থিক অবস্থার অবনতিতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকে ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘ নয় বছর ধরে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক থাকলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় অনিয়মের প্রশ্রয় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা সিকদার পরিবারের সদস্যদের দ্বন্দ্বে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা যা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশ। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। একই সময় মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৪ কোটি টাকা
আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে ব্যাংক কোম্পানি আইনে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ২১ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) এক আদেশে সমস্যা-জর্জরিত প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন। এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাত সদস্যবিশিষ্ট নতুন পর্ষদ গঠন করে।
আরও পড়ুন
নতুন পর্ষদে কারা থাকছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলাদা চিঠি দিয়ে তা–ও জানিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা ভালো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা আছে বলেই পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। একটি ব্যাংক চালাতে পর্ষদ বড় ভূমিকা পালন করে। তারা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। এ কারণে ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন নতুন পর্ষদের দায়িত্ব হবে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে তা আদায়ে জোর দেওয়া।’
‘যারা ঋণ পরিশোধ করবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের শাস্তির আওতায় আনা। শুধু ন্যাশনাল ব্যাংক নয়, যারা খারাপ অবস্থায় আছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত’— মনে করেন সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা।
ন্যাশনাল ব্যাংক প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দুই হাজার কোটি টাকা। এ টাকা কে দেবে? কারণ, টাকা দিয়ে তো লাভ নাই, লস হবে। ব্যাংক পরিচালনার জন্য অর্থ নেই। ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো কিছুটা সাপোর্ট দিতে পারবে। তবে, সেটারও একটা লিমিট আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করা কঠিন হবে। এখন যদি ভয়ে আমানতকারীরা টাকা তুলতে আসে, সামাল দিতে পারবে না ব্যাংকটি।
আরও পড়ুন
তিনি আরও জানান, এখন যেহেতু পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাই ব্যাংকের সঠিক অবস্থা জানা দরকার। ব্যাংকটির বর্তমান যে আর্থিক প্রতিবেদন, তা স্বচ্ছ নয়। তাদের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। তাই এখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অডিটর দিয়ে সঠিক আর্থিক অবস্থা নিরীক্ষা করা জরুরি।
ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা
২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা যা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশ। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। একই সময় মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৪ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নির্ধারিত সীমার অনেক ওপরে। যার হার ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশ। এ সময় ব্যাংকটি ধার করেছে ৮০৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া, আলোচ্য সময় ব্যাংকটি লোকসান করেছে এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা। রিটার্ন অন ইক্যুইটি ও অ্যাসেট ঋণাত্মক রয়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৪৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা
২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ কোম্পানির নিকট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এসব কোম্পানির ঋণ ‘রাইট অফ’ করেছে এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব কোম্পানির নিকট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। এ সময় শীর্ষ এসব কোম্পানির ঋণ ‘রাইট অফ’ করেছে এক হাজার ২৯০ কোটি টাকা।
আমানত ও ঋণ
২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। এ সময় ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ৩৯ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ৪২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ কমেছে এবং ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
সম্পদ কমেছে, ঝুঁকি বেড়েছে
২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৪৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
সারা দেশে ন্যাশনাল ব্যাংকের শাখা আছে ২২২টি। এর মধ্যে ৫০টি শাখা লোকসানে রয়েছে। ব্যাংকটিতে চার হাজার ৮৭৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত।
নতুন পর্ষদে যারা আছেন
নতুন করে যে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে সেখানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। যিনি বর্তমানে মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া, পরিচালক হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন, পারভিন হক সিকদার, উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী হিসেবে পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।
এদিকে, নতুন পর্ষদে থাকা এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে জানান, ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে রাখা হয়েছে জেনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মিটিং হয়নি। হয়তো চলতি সপ্তাহে পর্ষদের মিটিং হতে পারে।
ব্যাংকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে আছেন মো. মেহমুদ হোসেন। চলতি বছরে তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন এমডি খোঁজার জন্য পর্যবেক্ষককে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/এমএআর/