পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়াই গার্মেন্টস খোলা, ভোগান্তিতে শ্রমিকরা
কর্মকর্তাদের অফিসে যাতায়াতের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কোনো পরিবহন নেই। পরিবহনের ব্যবস্থা ছাড়াই খোলা রাখা হয়েছে বেশিরভাগ পোশাক কারখানা। ফলে করোনার প্রকোপ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) গার্মেন্টসে উপস্থিত হতে বেশ ভোগান্তিতে পড়েন শ্রমিকরা।
একদিকে রোজা অন্যদিকে লকডাউনের কারণে গণপরিবহন না থাকায় রিকশা, ভ্যান এমনকি পিকআপ ভ্যানে করে কারখানায় যাচ্ছেন তারা। তাতে যেমন কষ্ট করতে হচ্ছে, তেমনি ভাড়াও দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ।
বিজ্ঞাপন
অথচ কারখানা খোলা রাখতে মালিকরা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে বলেছিলেন, সকল স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন এবং শ্রমিকদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই কারখানা খোলা রাখা হবে। সেই আশ্বাসে সরকারও গত ১২ এপ্রিল শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করার শর্তে শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) থেকে মালিকরা কারখানা খোলা রেখেছেন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা করছেন না। তারা শ্রমিকদের জন্য কোনো পরিবহন ব্যবস্থা চালু করেননি। আর তাতে রাজধানীর আশপাশের আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকার কারখানাগুলোর শ্রমিকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। চাকরি হারানোর ভয়ে, রোজা রেখে পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কাজে যাচ্ছেন তারা।
মালিবাগ থেকে নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় চাকরি করেন সবুজ মিয়া ও তার স্ত্রী রিতা আক্তার। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠনের এক বড় নেতার এই প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের জন্য কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা করেনি। শুধু তাই নয়, সবাইকে কাজে যেতেও বাধ্য করা হয়েছে। ফলে সামনে ঈদ ও চাকরি রক্ষায় সেহরি খেয়ে হেঁটে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন স্বামী-স্ত্রী। তিন জায়গায় টহল পুলিশের জিজ্ঞাসাদের পর সকালে কারখানায় পৌঁছান তারা।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ (১৫ এপ্রিল) সকালে অন্তত ১০০ জন শ্রমিক আমাকে ফোন করে অভিযোগ করেন, পথে পথে পুলিশ বাধা দিয়েছে। পথে নেই কোনো যানবাহন, কখনও হেঁটে কখনও বা রিকশায় করে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা দিয়ে কারখানায় যেতে হচ্ছে তাদের।
তিনি বলেন, আমি প্রথম থেকেই বলেছি, গার্মেন্টস মালিকরা কখনো শ্রমিকদের কথা ভাবেন না। তারা বলেন এক, করেন আরেক। আমি বিষয়টি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করব।
সবুজ মিয়া ও রিতার মতই হাজার হাজার শ্রমিক রাজধানীর মালিবাগ, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, ধনিয়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে কাজ করেন। কোনো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের সবাইকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
একই অবস্থা সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন শিল্প এলাকায়। সেখানেও দেখা যায়, সকাল ৭ টা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে দলে দলে কারখানায় যাচ্ছেন পোশাককর্মীরা। কখন কারখানায় পৌঁছাবেন এই প্রতিযোগিতায় নেই তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব। তারা চাকরি ও সংসার বাঁচাতে অফিসে যাচ্ছেন।
পোশাক শ্রমিক রাকিব হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনে সবকিছু বন্ধ। আমি থাকি হেমায়েতপুর, সেখান থেকে আশুলিয়া তো হেঁটে আসা যায় না। কিছু দূর হেঁটে এসেছি। তারপর ভ্যানে করে এসেছি। ৬-৭ জনের জায়গায় ১০-১৫ জন বসেছি। আমরা কয়েকজন মাস্ক পরেছি। অনেক শ্রমিক মাস্কও পরছেন না।
তিনি বলেন, ১০ টাকার ভাড়া দিয়েছি ৪০ টাকা, গাদাগাদি করে আসছি। এখন ভয় হচ্ছে করোনা নিয়ে। এর মধ্যে যদি একজনের করোনা হয় তবে সবাই আক্রান্ত হবেন।
দূরের রাস্তা, তাই পিকআপ ভ্যানে করে কারখানায় যান নারী শ্রমিক রুবিনা। তিনি বলেন, কারখানায় আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। পুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে পিকআপ ভ্যানে উঠেছি, গাদাগাদি করে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে কারখানায় এসেছি। ১০ টাকার ভাড়া দিয়েছি ৫০ টাকা। আমাদের এই কষ্ট দেওয়ার কী দরকার ছিল? তার চেয়ে ছুটি দিয়ে দিতো।
গাজীপুর থেকে পায়ে হেঁটে টঙ্গী কারখানায় আসা মেশকাত আলামীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাস শেষে বেতন পাই ১২ হাজার টাকা। আজ সকালে অফিসে আসতে অটোরিকশাওয়ালাকে বলে থামিয়েছি। ভাড়া চেয়েছে ১৫০ টাকা। তাই ক্ষোভে হেঁটে এসেছি। আমরা শ্রমিক, আমাদের কথা কেউ শোনে না।
শ্রমিকদের জন্য বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা নেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ৯০ শতাংশ গার্মেন্ট শ্রমিক কারখানার আশপাশেই থাকেন। তারা পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে করে অফিসে আসেন। বাকি ১০ শতাংশ শ্রমিক রয়েছেন, তাদের বিষয়ে মালিকদের বলেছি, যদি তারা আসতে পারেন, তবে আসবেন আর না এলে জোর করা যাবে না। তাদের চাকরিও যাবে না।
১০ শতাংশ শ্রমিক গার্মেন্ট থেকে দূরে থাকে এই তথ্য ভুল উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই তথ্য ঠিক নয়। বিজিএমইএ আন্দাজে বলছে, প্রকৃত তথ্য হচ্ছে এখনো ৩০-৪০ শতাংশ শ্রমিক গার্মেন্ট থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে থাকেন। তাদের জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমইএ কোনো মালিক সংগঠন পরিবহন ব্যবস্থা চালু করেনি।
শ্রমিকদের তুলনায় অফিসার কম উল্লেখ করে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, অফিসারদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। তারা অফিসের পরিবহন ব্যবস্থায় আসা-যাওয়া করেন। তাদের মধ্যে করোনার ঝুঁকিও বেশি। কিন্তু শ্রমিকরা কষ্টও বেশি করেন, তাদের করোনাও কম হয়।
একই কথা বলেন বিজিএমইএর শ্রম বিভাগের পরিচালক ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল শ্রমিকরা দূরে থাকতেন। এখন সেই অবস্থা নেই। বেশিরভাগ শ্রমিক এখন কারখানার কাছাকাছি থাকেন। তবে গণপরিবহন না থাকায় এখন কষ্ট একটু বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
করোনা বিষয়ক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সঠিক নিয়ম মেনে কারখানাগুলো খোলা হয়েছে কি না দেখা হচ্ছে। কোথাও কোনো নিয়মের ব্যত্যয় দেখলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না দেখভালের জন্য কয়েকটি কমিটি করেছি। কমিটির রিপোর্ট দেখেছি। বেশিরভাগ কারখানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। যেগুলোতে কিছু সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এমআই/এইচকে/জেএস