মন্দ ক্যাটাগরিতে যাবে ১৩টি
ব্যাংকের বিপর্যয় ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, পরিচালকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ঋণ কেলেঙ্কারি, লাগামহীন ঋণখেলাপি, মূলধন সংকটসহ নানা সমস্যায় সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। পাশাপাশি সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ব্যাংক খাতে দুর্ভোগ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ব্যাংকের তারল্য সংকট, পরিচালক নিয়োগ, উচ্চমাত্রার খেলাপি এবং বেনামী ঋণ বন্ধ করতে সংস্কার পরামর্শ দিয়ে আসছে। এসব বিবেচনায় আর্থিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ব্যাংকের আস্থা ধরে রাখা ও বিপর্যয় ঠেকাতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আগামীতে চারটি ক্যাটাগরিতে ব্যাংকগুলোর মান নির্ধারণ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রেশিও, মালিকদের শেয়ার রেশিও, মূলধন সংরক্ষণসহ খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করা হবে। এতে করে মন্দ বা খারাপ মানের ব্যাংক সহজে চিহ্নিত করা যাবে। খারাপ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নতুন আমানত সংগ্রহ ও কোনো ঋণ দিতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ‘দ্রুত সংশোধনমূলক পদক্ষেপ (পিসিএ)’ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নের নির্দেশনা জারি করেছে।
বিপর্যয়ের হাত থেকে ব্যাংকিং খাতকে উদ্ধার করতে সংশোধনীমূলক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশে সব ধরনের দেশি ও বিদেশি ব্যাংকের শাখার ওপর ‘পিসিএ’ বাস্তবায়ন হবে। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে সব ক্যাটাগরির ব্যাংকগুলোকে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে তা সবচেয়ে ‘দুর্বল’ বা ‘খারাপ’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
পিসিএ নিয়ে সার্কুলারে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যাংকের মান উন্নয়নে পিসিএ এর আওতায় ‘ডিরেক্টিভস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-ডিওবিবি বা ডব’ ইস্যু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বলতা কাটিয়ে ব্যাংকের মান উন্নয়নে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে একীভূত করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঁচ সূচক দিয়ে চারটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হবে। এগুলো হলো- সংশোধনী পরিকল্পনায় ব্যাংকগুলোকে ক্যাপিটাল টু রিস্ক অ্যাসেট রেটিও (সিআরএআর), ক্যাপিটাল রেটিও (সিআর), কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ (সিইটি১) রেশিও, নেট নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) এবং এবং করপোরেট গর্ভনেন্স বা সুশাসন। এই সূচকগুলোকে ভিত্তি করে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এসব সংশোধনী কার্যাবলি ২০২৫ সালের ৩১শে মার্চ থেকে বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ প্রদান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশোধনীগুলো দেশের অভ্যন্তরে সব তফসিলি ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের কেন্দ্র থেকে শাখা পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে পর্ষদ সভার অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আগামীতে চারটি ক্যাটাগরিতে ব্যাংকগুলোর মান নির্ধারণ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রেশিও, মালিকদের শেয়ার রেশিও, মূলধন সংরক্ষণসহ খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করা হবে। এতে করে মন্দ বা খারাপ মানের ব্যাংক সহজে চিহ্নিত করা যাবে। খারাপ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নতুন আমানত সংগ্রহ ও কোনো ঋণ দিতে পারবে না।
ব্যাংকের সংকট উত্তোরণে নতুন করে সংশোধনী আগামী ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের আলোকে প্রস্তুত করবে। যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পূর্ব নির্ধারিত পর্ষদ সভায় পরিচালকদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। এ নীতিমালা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৭/ক ধারা, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার এবং তফসিলি ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমওইউ এর আলোকে করতে হবে এমন নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংক সংশোধনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেয়া পদক্ষেপ নিজেরাই বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য থাকবে। পিসিএ শুরু করার পরে সংশোধনমূলক নির্দেশক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা নামে জারি করা হবে। ব্যাংকের অবনতিশীল আর্থিক ও পরিচালন সূচক অবস্থার স্বাভাবিক উন্নতি বছরের মধ্যে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে একটি গ্যারান্টি প্রদান করতে হবে।
ব্যাংকগুলোর মুলধন ও খেলাপি ঋণ (শ্রেণীকৃত ঋণ বা এনপিএল) বিবেচনায় চারটি ক্যাটাগরির মান নির্ধারণ করবে। যদি কোনো ব্যাংক চারটি ক্যাটাগরির মধ্যে প্রথম ক্যাটাগরিতে পড়ে যেসব ব্যাংককে খারাপ বলে বিবেচনা করা হবে।
ক্যাপিটাল টু রিস্ক (ওয়েটেড) অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) হচ্ছে একটি ব্যাংকের মূলধনের সাথে ব্যাংকটির রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট এবং বর্তমান ঋণের অনুপাত। যেসব ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা (সিআরএআর) ১০ শতাংশ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের মধ্যে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-১ হিসাবে বিবেচনা হবে। সিআরএআর ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-২, ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-৩ এবং যাদের ৫ শতাংশের নিচে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-৪ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
আন্তুর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম মূলধনের অনুপাত ৬ শতাংশ অবশ্যই থাকতে হবে। যাদের মূলধনের অনুপাত সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-১ হিসেবে বিবেচনা হবে। সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ এর মধ্যে থাকবে তারা ক্যাটাগরি-২ এ পড়বে, ৩ থেকে সাড়ে ৪ এর ক্যাটাগরি-৩ এবং মূলধনের অনুপাত ৩ শতাংশের নিচে থাকলে ক্যাটাগরি-৪ মানে সব চেয়ে খারাপ ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হবে।
একইভাবে ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন-এনপিএল( খেলাপি ঋণ) যেসব ব্যাংকের ৮ শতাংশের নিচে আছে তাদের ক্যাটাগরি-১ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। ৮ শতাংশের বেশি ১১ শতাংশের কম হলে ক্যাটাগরি-২, ১৪ শতাংশের নিচে ১১ শতাংশের বেশি হলে ক্যাটাগরি-৩ এবং ১৪ শতাংশের বেশি হলে ক্যাটাগরি-৪ বা খারাপ হিসেবে বিবেচনা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী সরকারি-বেসিরকারি ১৩টি ব্যাংকের এনপিএল বা খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১৪ শতাংশের বেশি রয়েছে।
১৪ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৬ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বিডিবিএল-এর ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৪ শতাংশ ও বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ।
এছাড়া বেসরকারি এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৮ দশমকি ৩২ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩২ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৬৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংক মন্দ বা খারাপ বলে বিবেচিত হবে।
যেসব ব্যাংক ক্যাটাগরি-২-এ থাকবে তারা লভ্যাংশ দিতে পারবে না এবং পরিচালন ব্যয় ৫ শতাংশের বেশি করতে পারবে না। ক্যাটাগরি-৩ এ থাকা ব্যাংক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ ৫ শতাংশের বেশি বাড়াতে পারবে না এবং পরিচালন ব্যয় করতে পারবে ৩ শতাংশ। ক্যাটাগরি-৪ থাকা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নতুন আমানত সংগ্রহ করতে পারবে না। পাশাপাশি কোনো ঋণও দিতে পারবে না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে এখন বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। সুশাসনের ঘাটতি মেটাতে পারলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকার, গ্রাহক ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে একটি বার্তা দিতে হবে। আর তারল্য সংকট, ঋণের গুণগত মান, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি, পরিচালকদের বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ এসব সমস্যা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে কমে যেতে বাধ্য হবে।’
সূত্র জানায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বর্তমানে সুনির্দিষ্টভাবে মার্জার নীতিমালা নেই। দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হতে পারে সেজন্য গত বছরের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক উদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে এবার ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ঠেকাতে সংশোধনী কার্যাবলি নিতে নির্দেশ দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে ব্যাংকগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন (ক্যাপিটাল) রাখতে হয়। এর বাইরে কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে সেটিতে মূলধনও বেশি রাখতে হয়।
ব্যাসেল গাইডলাইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদও বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। ভালো ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম হিসেব করা হয়। আবার খারাপ বা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ধরনের সম্পদকে কেন্দ্র করে কোন ব্যাংক কী পরিমাণ মূলধন রাখবে তা নির্ণয় করা হয়।
ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী যেকোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর সঙ্গে আপৎকালীন সুরক্ষা মূলধন (ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার-সিসিবি) হিসেবে আরও আড়াই শতাংশ মূলধন রাখার বিধান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যাংকের খেলাপি বা মন্দ ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়।
কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষ ১৫টি ব্যাংক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এগুলো হলো— রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংক; বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক; বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
এসআই//এমটিআই