ঋণ জালিয়াতি ঠেকাতে জামানত মূল্যায়নে নয়া কৌশল
দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ জালিয়াতির অন্যতম উপাদান হচ্ছে ভুয়া জামানত। আবার অনেক সময় জামানতের মূল্য বেশি দেখিয়ে কিছু প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যবসায়ী জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার হাতিয়ে নিচ্ছে। পরে খেলাপি হলে জামানত বিক্রি করেও ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে জামানত জালিয়াতি ঠেকাতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করেছে।
বিজ্ঞাপন
নীতিমালার নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণের বিপরীতে জামানত মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়ার আগে এই প্যানেল থেকে একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে জামানত মূল্যায়ন করতে হবে। প্যানেলভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টের ভিত্তিতেই কেবল ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। তবে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ মঞ্জুর করতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জামানত মূল্যায়ন করতে পারবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা বা তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরি, বর্ধিতকরণের বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নবায়নের সময় গৃহীত বা গৃহীতব্য জামানত (সম্পত্তি, মালামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) ন্যূনতম দুটি জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, একাধিক মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান বা মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মূল্যায়নের মধ্যে যে মূল্যায়ন ব্যাংকের জন্য অধিকতর অনুকূলে হবে তা গ্রহণ করতে হবে। তবে উভয় মূল্যায়নের ব্যবধান ২০ শতাংশের অধিক হলে ব্যাংক মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারবে।
আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঋণের টাকা আত্মসাত করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে জামানত রাখা সম্পদের মূল্য বাড়িয়ে দেখায়। তাদের খপ্পরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংক। ঝুঁকিতে পড়েন আমানতকারী ও ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা। ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান বিপুল খেলাপি ঋণের এটি অন্যতম কারণ।
নির্দেশনায় বলা হয়, ঋণের ঝুঁকি কমাতে ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সাধারণত স্থাবর সম্পত্তি (জমি ও ইমারত) এবং অস্থাবর সম্পত্তি (মেশিনারিজ, সহজে বিপণনযোগ্য দ্রব্যাদি) জামানত হিসেবে গ্রহণ করে। ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা, খেলাপি ঋণ আদায়, অবলোপন, নন-ব্যাংকিং সম্পদ অন্তর্ভুক্তিকরণ, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণসহ শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে রাখা প্রভিশন সঠিকভাবে হিসাবায়নের প্রয়োজনে ঋণের বিপরীতে রাখা জামানতের যথাযথ ও নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন খুবই জরুরি।
এতে বলা হয়, যথাযথ ও নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য যোগ্য জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম যোগ্যতা ও উপযুক্ততা নির্ধারণ সাপেক্ষে তালিকাভুক্তি এবং তালিকা প্রকাশ অত্যাবশ্যক। কোনো ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত মূল্যায়নের জন্য যোগ্য জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সুনির্দিষ্ট, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে তালিকাভুক্তি করতে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো।
জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম যোগ্যতা-
তালিকাভুক্তির জন্য জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নিম্নোক্ত ইন্সটিটিউশন বা অ্যাসোসিয়েশনসমূহের মধ্যে ন্যূনতম একটির সদস্যপদ থাকতে হবে।
১. বাংলাদেশ সার্ভে অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন কোম্পানিজ, ফার্মস অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল কনসার্নস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসভিসিএফআইসিএ)।
২. বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স সার্ভেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন। ৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় সমজাতীয় স্বীকৃত কোনো পেশাজীবী সংগঠন।
এসব সংগঠনের সদস্য ছাড়াও ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ এবং ইন্সটিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের সদস্য এ সার্কুলারে করা শর্তগুলো পূরণ করে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবে।
এছাড়া ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি) জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সার্ভে বা ভ্যালুয়েশন কাজে ন্যূনতম ৩ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল (হিসাবরক্ষক, পুরপ্রকৌশলী, যন্ত্রপ্রকৌশলী, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী) এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সার্ভেয়ার থাকতে হবে। এছাড়া মূল্যায়ন কাজে প্রতিষ্ঠানের আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সুবিধা থাকতে হবে।
আরও বলা হয়, জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকাভুক্তির কার্যক্রম শুরু করবে। এসব প্রতিষ্ঠানের আবেদন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতি বছরে দুইবার যোগ্য জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করবে। জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৩ বছর। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে তালিকাভুক্তির তারিখ থেকে প্রতি ৩ বছর পর পর (মেয়াদপূর্তির ৬ মাস পূর্বে) পুনরায় তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে।
এসআই/এসএম