চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা কণ্ঠশিল্পীসহ সব তারকা করদাতার অধিক্ষেত্র কর অঞ্চল-১২, যা অনেকের কাছে তারকা কর অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। রাজধানী ঢাকা ও তার আশেপাশের কয়েকটি এলাকা নিয়ে গঠিত কর অঞ্চলটির প্রধান লক্ষ্য ভীতিহীন কর সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ফলপ্রসূ অডিটের মাধ্যমে করের পরিধি বৃদ্ধি করা। 

সীমিত জনবল ও অফিস স্পেস সংকট নিয়েও সর্বোচ্চ সেবা দিতে শতভাগ অটোমেশনকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন কর অঞ্চলটির কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। রাজধানীর পুরানা পল্টনের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির মদিনা টাওয়ারে কর অঞ্চলটির অবস্থান। অফিসের ৫ম তলার ৯টি বিশেষ বুথে দেওয়া হচ্ছে কর সেবা। কর তথ্যসেবা মাসের প্রথম অর্থাৎ গত ১ নভেম্বর থেকে কর অফিসটিতে চলছে মিনি করমেলা। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থায় রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, ইটিআইএন, ডিজিটাল চালানসহ কর সেবা নিচ্ছেন করদাতারা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হিসাবে বুথগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

সরেজমিন পরিদর্শন ও কর অফিস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, কর অঞ্চল-১২ এর আওতায় এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৩১ হাজার ১৯৪ ব্যক্তি ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে ২১ হাজারের বেশি করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। আর গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছিলেন ৫ লাখ ১ হাজার ৮৫১ জন করদাতা। ওই বছর রিটার্ন দাখিল হয়েছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯০ করদাতার। ঢাকার বাইরে ৪০ হাজারের বেশি করদাতা নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে থাকেন। কর অঞ্চলটিতে প্রতি বছর গড়ে ৩৫-৪০ শতাংশ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন।

চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এ কর অঞ্চলে এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যেখানে গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০০ কোটি টাকা, যা আদায়ের পরও বাড়তি ৩০ কোটি টাকা আয় করেছিল কর অঞ্চলটি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এরইমধ্যে ২৫৪ কোটি টাকা আহরণ করে ফেলেছে। বকেয়া রাজস্ব আদায় ও করদাতারা যথাযথভাবে কর দিলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব বলেই মনে করছেন কর অঞ্চল-১২ এর কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

রাজধানীর রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গিরচর, বসিলা, চকবাজারের আংশিক এলাকা এবং ঢাকার বাইরে আশুলিয়া, মানিকগঞ্জ, সাভার ও ধামরাই এলাকা নিয়ে গঠিত কর অঞ্চল-১২। ঢাকার বাইরে ৫টি সার্কেল, বাকি ১৭টি সার্কেল ঢাকার মধ্যে রয়েছে। এর পাশাপাশি ইংরেজি অক্ষর ‘S’ অদ্যাক্ষরের কোম্পানিগুলোও এই অঞ্চলের করদাতা। যার মধ্যে রয়েছে স্কয়ার, রেটিনা ও রবির মতো বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তারা। 

কর অফিস সূত্র বলছে, কর অঞ্চল-১২ এর আওতায় থাকা ২২টি কর সার্কেলের আওতাধীন করদাতাদের করসেবার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং করদাতাদের অভিযোগ সমাধানে বিশেষ টিম নিয়োগ করা হয়েছে। এই অফিসটিতে অনুমোদিত ২৬১টি পদের মধ্যে ২২৩টি পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে যথাযথ সেবা দিতে আরো লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কর অঞ্চল-১২ এর কর কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে আমাদের অফিস বিশেষ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আমরা আমাদের অফিসে শতভাগ করবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য হলো কর অঞ্চলের সব সার্কেলগুলোকে একই ছাতার মধ্যে আনা। এটা করতে পারলে কর সেবা ও সঠিকভাবে কর আদায় সহজ হয়ে যাবে এবং অডিট কার্যক্রম ফলপ্রসূ হবে। কর কর্মকর্তা ও অফিস স্পেসের সংকট রয়েছে। আমি চাই তথ্যের অবাধ প্রবাহ হোক, সেজন্য শতভাগ অটোমেশনের বিকল্প নেই।  

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি বছরে আমরা ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স (টিডিএস) মনিটরিংকে জোরদার করতে চাই। বিচারাধীন ছাড়া আমাদের বর্তমানে ৭৮ কোটি টাকার বেশি কর বকেয়া রয়েছে। আর আদালতের বিচারাধীন মামলা জটে প্রায় ৮১৬ কোটি টাকার রাজস্ব আটকে আছে। মামলা জট কমাতে আমার বিবেচনায় আর্থিক মামলাগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

করদাতাদের আহ্বান জানিয়ে আবুল কালাম আরও বলেন, এবারে নতুন আইন হয়েছে। করদাতাবান্ধব ও বাংলায় আইন হলেও সময়মতো আয়কর রিটার্ন না দিলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। রিটার্ন দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের ঘাটতি থাকলেও রিটার্ন দিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেব। আপনি চাইলে পরেও কাগজপত্র দিতে পারবেন। কাগজপত্রে বড় ধরনের গ্যাপ না থাকলে করদাতাদের সমস্যার মুখোমুখি হবেন না।

অন্যদিকে কর অফিসটিতে কর্মরত কর্মকর্তারা বলছেন, করদাতাদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে অটোমেশনের বিকল্প নেই। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে করদাতাদের সেবা কিংবা কর ব্যবস্থাপনা কর অসম্ভব। ভবিষ্যতে পরিসর আরও বৃদ্ধি পাবে, তখন এই জনবল ও এতো ছোট অফিসে কর সেবা দেওয়া খুবই কষ্টকর হবে। ছোটো-খাটো অটোমেশনের উদ্যোগ নিলে হবে না, বড় আকারের এমন প্রজেক্ট নিতে হবে, যা আগামী ১০০ বছর ওই সিস্টেমের আওতায় চলবে। বর্তমানে যেসব প্রজেক্ট চলমান রয়েছে তার সক্ষমতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকা পোস্টের কাছে অনেক কর্মকর্তাই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

রিটার্ন দাখিল করতে এসেছেন ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে কর্মরত সুজন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবরোধের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সময় বৃদ্ধি করা উচিত। এই কর অফিসের অনেক করদাতা কিন্তু করসেবার বুথ কম। বুথ ও অফিস স্পেস বৃদ্ধি করা দরকার বলে মনে করি। মিনি করমেলা খোলা জায়গায় হলে ভালো হতো। অতিরিক্ত ভিড় ঢেলে রিটার্ন জমা দেওয়াটাই আমার কাছে হয়রানি। অনলাইন রিটার্ন দেওয়ার প্রচারণায়ও ঘাটতি রয়েছে।

কর অঞ্চলগুলোতে যে সব সেবা মিলছে

>> প্রতিটি অফিসে উন্মুক্ত স্থান বা কার পার্কিং এরিয়ায় রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিলকারী করদাতাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া হচ্ছে।

>> অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।

>> সব কর কমিশনার সেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। থাকছে এ-চালান গ্রহণ বুথ।

>> সব কর অঞ্চলের কমিশনাররা তাদের নিজ নিজ কর অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

>> ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৪টি কর অঞ্চলে কেন্দ্রীয়ভাবে ও অন্য সব কর অঞ্চল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলছে মিনি করমেলা।

 আরএম/জেডএস