প্রান্তিক করদাতাদের হয়রানিমুক্ত সেবা, সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতকে করের আওতায় আনা ও বকেয়া রাজস্ব আদায়কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে কর অঞ্চল-১৫। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিক্ষেত্র হিসাবেই পরিচিত ওই কর অফিসটি। 

নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও করের আওতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সীমিত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন অফিসটি।

রাজধানীর নয়া পল্টনের ভিআইপি রোডে কর অঞ্চলটির অবস্থান। অফিসের ১৬তলার (লিফট-১৫) পুরো ফ্লোরে ১২টি বিশেষ বুথে দেওয়া হচ্ছে কর সেবা। গত ১ নভেম্বর থেকে আয়োজিত করমেলা চলবে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। যেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, ইটিআইএন, ডিজিটাল চালানসহ কর সেবা নিচ্ছেন করদাতারা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হিসাবে বুথগুলোতে ভিড়ও বেড়েছে খানিকটা।

সরেজমিন পরিদর্শন ও কর অফিস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, কর অঞ্চল-১৫ এর আওতায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার ব্যক্তি ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে ১৮ হাজারের কিছু বেশি করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। যেখানে গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৪৫২ করদাতা। ওই বছরে রিটার্ন দাখিল হয়েছিল ৬১ হাজার ৬৯০ করদাতার। প্রতি বছর গড়ে ৫০-৬০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন।

চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এ কর অঞ্চলে এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যেখানে গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬০ কোটি টাকা, যা আদায়ের কাছাকাছি গিয়েছিল বলেও জানা গেছে। এর আগে অক্টোবর পর্যন্ত ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ২৬৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আহরণ করে ফেলেছে কর অঞ্চলটি। লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হলেও অর্জন অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন কর অঞ্চল-১৫ এর কমিশনার আহসান হাবিব।

রাজধানীর মতিঝিল,পল্টন, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, আরামবাগ ও শান্তিনগর এলাকা নিয়ে গঠিত কর অঞ্চল-১৫। এর পাশাপাশি ইংরেজি অক্ষর F এবং J অদ্যাক্ষরের কোম্পানিগুলোও এই অঞ্চলের করদাতা। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কর অঞ্চলের করদাতা। এছাড়া আলোচিত বেসিক ব্যাংক, আনসার বিডিবি ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকসহ বেশকিছু বিশেষায়িত ব্যাংকের কর্মরতরা এই কর অঞ্চলে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে থাকেন। সরকারি ব্যাংকাররা কর অঞ্চল-১৫ এর করদাতা হলেও লক্ষ্যমাত্রার প্রধান উৎস হিসাবে সোর্স ট্যাক্স বা উৎস করকে প্রাধান্য দিচ্ছে এই অফিস। পাশাপাশি অনলাইনে রিটার্ন দাখিলকে বিশেষ নজর দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত দারাজ, ফুডপান্ডা ও পাঠাওসহ ই-কমার্সভুক্ত কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান, কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, টেলিযোগাযোগ খাতের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) ও আইসিএক্স জাতীয় অপারেটর এই কর অঞ্চলের আওতাধীন। এছাড়া সরকারের মেগা প্রজেক্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ের টোল কিংবা সরকারি ব্যয়ের ওপর উৎসকর পাচ্ছে কর অঞ্চল-১৫। ওই খাত থেকে কর হিসাবে শত কোটি টাকার বেশি আদায় হচ্ছে বলে জানা গেছে। 

উদীয়মান শিল্প হিসাবে ই-কমার্স জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই অর্থে কর আদায় না হলেও ভবিষ্যতে কর আহরণের অন্যতম প্রধান খাত হতে যাচ্ছে এটি। এসব বিষয় মাথায় রেখে এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ জরিপ কাজ চালাচ্ছে সরকার। যার অংশ হিসাবে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি (ডিবিআইডি) নামের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতাধীন ই-কমার্স কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে করে আওতায় আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ডিবিআইডি’র আওতায় ৮২০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠান ই-টিআইএনধারী নয়, আগামীতে যাতে ডিবিআইডির নিবন্ধন নিতে ই-টিআইএন নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করা হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে বড় অংকের কর আসবে বলে মনে করছেন কর অঞ্চল-১৫ এর কমিশনার আহসান হাবিব।

কর অফিস সূত্র বলছে, কর অঞ্চল-১৫ এর আওতায় থাকা ২২টি কর সার্কেলের আওতাধীন করদাতাদের করসেবার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং করদাতাদের অভিযোগ সমাধানে বিশেষ টিম নিয়োগ করা হয়েছে। এই অফিসটিতে অনুমোদিত ১৯৯টি পদের মধ্যে ১৭৫টি পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে যথাযথ সেবা দিতে আরো লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন রয়েছে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কর অঞ্চল-১৫ এর কর কমিশনার আহসান হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে আমাদের অফিস বিশেষ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আমরা আমাদের অফিসে শতভাগ করবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে চাই। বিশেষ করে প্রান্তিক করদাতাদের হয়রানিমুক্ত করসেবা দিতে চাই। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে করদাতারা নির্ধারিত সময় ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মিনি করমেলায় যথাযথভাবে কর দেবেন ও দেশের উন্নয়নে অংশীদার হবেন। কারণ ৩০ নভেম্বরের রিটার্ন দাখিল করলে কর অব্যাহতিসহ সব সুবিধা থেকে বঞ্চিতের পাশাপাশি জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে করদাতাদের।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি বছরে আমরা ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স (টিডিএস) মনিটরিং ও আদায়যোগ্য বকেয়া কর আহরণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিচারাধীন ছাড়া আমাদের বর্তমানে ১০০ কোটি টাকার বেশি কর বকেয়া রয়েছে। এরইমধ্যে ২৫ কোটি টাকার মতো আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের শতভাগ চেষ্টা থাকবে। 

করদাতাদের আহ্বান জানিয়ে আহসান হাবিব আরও বলেন, করদাতারা যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে আপনারা সরাসরি কর রেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এরপরও যেকোনো অভিযোগ জানিয়ে গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করুন। আমরা প্রতিমাসে দুটি গণশুনানি আয়োজন করে করদাতাদের বক্তব্য শুনে থাকি।

অন্যদিকে রিটার্ন দাখিল করতে আসা সামিরা আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবরোধের মধ্যেও রিটার্ন দাখিল করতে এসেছি। পথে পথে ঝুঁকি রয়েছে। তারপরও নির্ধারিত রিটার্ন দাখিল করতেই এখানে এসেছি। মিনি করমেলার পরিবেশ ভালো লেগেছে। শেষদিকে ভিড় একটু বেশি মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় সময় বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করি। 

কর অঞ্চলগুলোতে যেসব সেবা মিলছে

>> প্রতিটি অফিসে উন্মুক্ত স্থান বা কার পার্কিং এরিয়ায় রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিলকারী করদাতাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া হচ্ছে।

>> অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।

>> সব কর কমিশনার সেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। থাকছে এ-চালান গ্রহণ বুথ।

>> সব কর অঞ্চলের কমিশনাররা তাদের নিজ নিজ কর অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।

>> ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৪টি কর অঞ্চলে কেন্দ্রীয়ভাবে ও অন্য সব কর অঞ্চল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যথাযথ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে জেলা ও সিটি করপোরেশনভিত্তিক সেরা করদাতা সম্মাননা প্রদান করবে।

আরএম/জেডএস