করসেবা ও করজাল বিস্তারে নামমাত্র অটোমেশন নয়, পুরোপুরি অটোমেশনের গুরুত্ব দিচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির অধিক্ষেত্রে কর অঞ্চল-৬। সেটা করতে কর সংগ্রহ দ্বিগুণ-তিনগুণ হওয়ার পাশাপাশি বাড়বে করদাতা, বিশ্বাস কর অফিস কর্মকর্তাদের।

চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও করের আওতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সীমিত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন অফিসটি। শামিল হয়েছে দেশে চলমান কর তথ্য সেবা বা মিনি করমেলায়।

রাজধানীর পুরানো পল্টনের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির রোডে কর অঞ্চলটি অবস্থিত। অফিসের নীচেই গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে মিনি করমেলা। চলবে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। সেবা দিতে ১২টি বিশেষ বুথ করা হয়েছে। যেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, ইটিআইএন, ডিজিটাল চালানসহ কর সেবা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ অনলাইনে রিটার্ন দাখিলকে জোর দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যেখানে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৮০ কোটি টাকা, যা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল কর অফিসটি। এ বছরের দ্বিগুণ টার্গেট হলেও লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন কর অঞ্চল-৮ এর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম। 

সরেজমিন পরিদর্শন ও কর অফিস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, কর অঞ্চল-৬ এর আওতায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৯ হাজার ব্যক্তি ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে ৯ হাজারের কিছু বেশি করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। যেখানে গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছিলেন ১ লাখ ৬৫ হাজার করদাতা। ওই বছরে রিটার্ন দাখিল হয়েছিল ১ লাখ ২৮ হাজার করদাতা। অর্থাৎ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন করদাতারা।

রাজধানীর নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, নীলক্ষেত, গাউসিয়া, ধানমন্ডি ৩২ ও ২৭ নম্বর এলাকা নিয়ে গঠিত কর অঞ্চল-৬। এর পাশাপাশি ইংরেজি অক্ষর R এবং Y অদ্যাক্ষরের কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলের করদাতা। কর অঞ্চলের আওতায় প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি, সিমেন্ট কোম্পানি, কুরিয়ার সার্ভিস এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃকক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত করদাতা। বেসরকারি প্রায় অর্ধশত ব্যাংকে ও লিজিং কোম্পানি ৭৫ হাজার কর্মকর্তার রিটার্ন দাখিল হলেও করের বড় অংশ যায় বৃহৎ করদাতা ইউনিটে। ফলে কর অঞ্চলটির রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার প্রধান উৎস হিসেবে সোর্স ট্যাক্স বা উৎস করকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

কর অফিস সূত্র বলছে, কর অঞ্চল-৬ এর আওতায় মোট ২২ কর সার্কেল রয়েছে। কর অফিস ও বুথগুলোর করসেবার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং করদাতাদের অভিযোগ কিংবা যে কোনো সমস্যা সমাধানে বিশেষ টিম কাজ করছে। ই-টিআইএনধারীদের কর সেবা দেওয়া ও তাদের আয়করের জালে আনাসহ করদাতাদের কাঙ্ক্ষিত করসেবা দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে বলে জানা গেছে।

অঞ্চল-৬ এর কর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম

সার্বিক বিষয় জানতে চাইলে কর অঞ্চল-৬ এর কর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে আমাদের অফিস বিশেষ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নভেম্বের ১ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত করমেলার আঙ্গিকে মিনি করমেলা চলছে। করদাতাদের হয়রানিমুক্তভাবে কর সেবা নেওয়ার অনুরোধ করছি। এখানে সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। মিনি কর মেলায় রিটার্ন দাখিল ও প্রাপ্তি স্বীকারপত্রসহ সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি ৩০ নভেম্বরের আগেই রিটার্ন দাখিল করে কর সুবিধা গ্রহণ করবেন করদাতারা। এরপরে রিটার্ন দাখিল করলে কর অব্যাহতিসহ সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। সব সেবা দিতে আমাদের করদাতার পাশে আছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিআইএনধারী সব করদাতা যাতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, সেজন্য আমাদের আওতাধীন পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিএফও’কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত অংশীজনদের সাথে সভা করছি। উৎস করের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো কর কালেক্টর হিসাবে উৎস কর যথাযথ আদায়ের জন্য অনুরোধ করেছি। কারণ এখন পর্যন্ত আমাদের অফিসের জন্য এটাই রাজস্ব আহরণে বড় উৎস।

অন্যদিকে কর অফিসের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কর নেট বৃদ্ধি প্রধান অস্ত্র হতে পারে কর জরিপ। কিন্তু এখানে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের যথেষ্ট লোকবল ও এনফোর্সমেন্ট ইউনিট দরকার, যাদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার থাকবে। না হলে কোনো মার্কেট কিংবা বৃহৎ এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করতে তোপের মুখে পড়তে হয়। আর একটি বিষয় হলো সিস্টেমের উন্নতি প্রয়োজন। প্রয়োজন অটোমেশনে সরকারের বড় বিনিয়োগ। নামমাত্র অটোমেশন দিয়ে কর ব্যবস্থা সহজিকরণ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদে মানসম্মত সেবা ও সুফল পেতে হলে এর বিকল্প নেই, আর সেটা করতে পারলে কর দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে ফেরত আসবে। কিন্তু এটা এখনও অবহেলিত।

অন্যদিকে রিটার্ন দাখিল করতে আসা হিরণ নামের এক ব্যাংকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবরোধ ও হরতালের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে এসেছি। পথে পথে ঝুঁকি রয়েছে। তারপরও নির্ধারিত রিটার্ন দাখিল করতেই এখানে এসেছি।

কর অঞ্চলের কোনো সমস্যা বা অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর সেবার মান আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। নতুন করদাতাদের উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। একটি অফিসের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সার্কেল অফিস থাকার কারণে অনেক নতুন করদাতা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বিষয়টি সমাধানের অনুরোধ করবো।

কর অঞ্চলগুলোতে যে সব সেবা মিলছে-

>> প্রতিটি অফিসে উন্মুক্ত স্থান বা কার পার্কিং এরিয়ায় রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিলকারী করদাতাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া হচ্ছে।

>> অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।

>> সব কর কমিশনার সেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। থাকছে এ-চালান গ্রহণ বুথ।

>> সব কর অঞ্চলের কমিশনাররা তাদের নিজ নিজ কর অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

>> ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৪টি কর অঞ্চলে কেন্দ্রীয়ভাবে ও অন্য সব কর অঞ্চল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলছে মিনি করমেলা।

আরএম/এসএম