কর অঞ্চল-৭
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের করজালে আনার চ্যালেঞ্জ
রাজধানীর ইসলামপুর ও বাংলাবাজারসহ পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পাইকারি ব্যবসায়ী, বড় মার্কেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের করজালে আনার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে কর অঞ্চল-৭। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সীমিত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে ধীরে ধীরে করের আওতা বৃদ্ধি করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন অফিসটি।
দেশে চলমান কর তথ্য সেবা বা মিনি করমেলা আয়োজনেও শামিল হয়েছে কর অঞ্চল-৭। রাজধানীর সেগুন বাগিচায় বারডেম হাসপাতালের সামনে কর অফিস, সার্কেল অফিসগুলোর নিচে, ঢাকার বাইরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সার্কেল অফিসে গত ১ নভেম্বর থেকে চলছে মিনি করমেলা। চলবে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। সেবা দিতে ৮টি বিশেষ বুথ করা হয়েছে। যেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, ই-টিআইএন, ডিজিটাল চালানসহ কর সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী পাইকারি মার্কেট এলাকা ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে গত ৮ ও ৯ নভেম্বর বিশেষ কর মেলাও আয়োজন করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সাড়াও মিলেছে অভূতপূর্ব।
কর অফিস সূত্রে জানা যায়, এনবিআরের দেওয়া নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কর অঞ্চল-৭ এর লক্ষ্য। এখন পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২৩৮ কোটি টাকা।
লক্ষ্য পূরণ কঠিন হলেও অসম্ভব নয় বলে মনে করছেন কর অঞ্চল-৭ এর কমিশনার আবু হান্নান দেলওয়ার হোসেন। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৯৩০ কোটি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল কর অফিসটি।
সরেজমিন পরিদর্শন ও কর অফিস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, কর অঞ্চল-৭ এর আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন। যেখানে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার করদাতা। ওই বছরে রিটার্ন দাখিল করেন ৮০ হাজার করদাতা। অর্থাৎ ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করে থাকেন।
আরও পড়ুন
ঢাকার ইসলামপুর, নবাবপুর, বাংলাবাজার, ওয়ারীর বড় অংশ এবং ঢাকার বাইরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর এলাকা নিয়ে গঠিত কর অঞ্চল-৭। এর পাশাপাশি ইংরেজি অক্ষর এইচ(H) এবং আই (I) আদ্যাক্ষরের কোম্পানিগুলোও এই অঞ্চলের করদাতা। কর অঞ্চলের আওতায় বড় কোনো কোম্পানি না থাকলেও রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ হোটেল মালিকের বড় একটি অংশ এই কর অঞ্চলের নিয়মিত করদাতা। সেখানেই আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তারা।
সূত্রে আরও জানা যায়, রাজধানীর হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো এই অঞ্চলের আওতায় হলেও এখনো মাত্র ১৫০০-এর মতো কর অঞ্চল-৭ এ রিটার্ন দাখিল করে। যেখানে এখন পর্যন্ত করদাতা হিসাবে তালিকাভুক্ত হোটেলের সংখ্যা ৪ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে দুই হাজারের মতো হোটেল-রেস্টুরেন্ট কর অঞ্চল ৬,৮ ও ১০ কর অঞ্চলের আওতাধীন। ফলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না অঞ্চল-৭। চলতি অর্থবছরে কর অফিসটির লক্ষ্যমাত্রা অন্তত ৫০০ এর মতো হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিকদের করের আওতায় আনা। টার্গেট পূরণে ইতোমধ্যে দফায়-দফায় আলোচনা ও সরেজমিন পরিদর্শনের কাজ চলছে। এর পাশাপাশি ইসলামপুর, নবাবপুর, বাংলাবাজার, ওয়ারী এলাকায় গত ১০ বছরে স্থাপিত মার্কেটগুলোকে নিয়েও কর জরিপ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে কাজ করছে যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পৃথক দুইটি বিশেষ টিম।
কর অঞ্চল-৭ এর আওতায় মোট ২২ কর সার্কেল রয়েছে। কর অফিস ও বুথগুলোর করসেবার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং করদাতাদের অভিযোগ কিংবা যে কোনো সমস্যা সমাধানে বিশেষ টিম করদাতাদের অভিযোগে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। যদিও ই-টিআইএনধারীদের কর সেবা দেওয়া ও তাদেরকে আয়করের জালে আনাসহ করদাতাদের কাঙ্ক্ষিত করসেবা দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
লোকবল সংকটের বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, করনেট বৃদ্ধি করা ও বিদ্যমান প্রায় ২ লাখ টিআইএনধারী করদাতাকে করের আওতায় যথাযথভাবে আনতে হলে অবশ্যই জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। সেখানে কর অঞ্চল-৭ এর কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ২৬১ জন থাকার কথা থাকলেও সেটাই নেই বর্তমানে। কর অফিসটিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে ২০০ জন কর্মরত রয়েছেন। যা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া রয়েছে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব।
সার্বিক বিষয়ে কর অঞ্চল-৭ এর কর কমিশনার আবু হান্নান দেলওয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর অঞ্চল-৭ এর আওতাধীন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রতিটি সার্কেলে কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে বিশেষ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আমরা চাই করদাতারা হয়রানিমুক্তভাবে কর সেবা নেবেন এবং ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন। করদাতাদের অভিযোগ জানার জন্য বুথের সামনেই রাখা হয়েছে অভিযোগ বক্স। অভিযোগ পেলে গণশুনানির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করছি। প্রতি মাসে ন্যূনতম একটি গণশুনানি হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিআইএনধারী সব করদাতা যেন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, সেজন্য আমাদের আওতাধীন প্রতিটি অফিস প্রধানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে সভা করছি। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১২টি মতবিনিময় সভা করেছি। আমাদের যেহেতু বড় ধরনের করদাতা বা কোম্পানি নেই। তাই আমরা উৎস করের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর কালেক্টর হিসাবে উৎস কর যথাযথ আদায়ের জন্য অনুরোধ করছি। কারণ এখন পর্যন্ত আমাদের অফিসের জন্য এটাই রাজস্ব আহরণের বড় উৎস।
অন্যদিকে রিটার্ন দাখিল করতে আসা আবদুল্লাহ নামের এক করদাতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিটার্ন দাখিল করার ভালো-মন্দ দুই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। কর সেবার মান আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। হয়রানি এখনো আছে, বুথের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে সেবা আরও ভালো হতো। নতুন করদাতারা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি বলেন, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষের রিটার্ন জমা দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে করদাতাদের রিটার্ন জমা দেওয়া কঠিন। প্রয়োজনে রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
কর অঞ্চলগুলোতে যে সব সেবা মিলছে
>> প্রতিটি অফিসে উন্মুক্ত স্থান বা কার পার্কিং এরিয়ায় রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিলকারী করদাতাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া হচ্ছে।
>> অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
>> সব কর কমিশনার সেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। থাকছে এ-চালান গ্রহণ বুধ।
>> সব কর অঞ্চলের কমিশনাররা তাদের নিজ নিজ কর অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
>> ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৪টি কর অঞ্চলে কেন্দ্রীয়ভাবে ও অন্য সব কর অঞ্চল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কর সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আরএম/এমজে