পৌনে ৬ লাখ টিআইএনধারীকে করজালে আনতে চায় অঞ্চল-৩
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উদ্যোগে দেশের ৩১টি কর অঞ্চলে চলছে কর তথ্য সেবা বা মিনি করমেলা। গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মেলা চলবে আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। দেশের অন্যান্য কর অঞ্চলের মতো কর অঞ্চল-৩ এর আওতায় সার্কেল অফিসগুলোতেও চলছে মেলার পরিবেশে সেবা। টার্গেট ৫ লাখ ৭৩ হাজার ই-টিআইএনধারীকে করের আওতায় আনা এবং চলতি অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার কোটি টাকা আহরণ করা। বেসরকারি কোম্পানি ও দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা এই অঞ্চলের নিয়মিত করদাতা।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ১২তলা ভবনের তিনটি ফ্লোরে চলছে কর অঞ্চলের কর্মকাণ্ড। প্রতিটি তলায় অফিসের সামনে, পুরোনো এনবিআর ভবন প্রাঙ্গণ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীসহ ২২ কর সার্কেল অফিসে বিশেষ ব্যবস্থায় রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, ই-টিআইএন, ডিজিটাল চালানসহ মোট ১৭টি বুথে স্থাপন করে দেওয়া হচ্ছে কর সেবা।
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় কর অঞ্চল-৩ এর প্রধান কার্যালয় হলেও ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে বড় অংশের করদাতারা রয়েছেন। ওই তিন জেলায় প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার করদাতা রয়েছেন বলে জানা গেছে। যার মধ্যে ফরিদপুরে ১ লাখ ২২ হাজার ৩৩৩ জন, গোপালগঞ্জে ৬২ হাজার ৮৬ জন এবং রাজবাড়ীতে ৪৯ হাজার ৩৯৪ জন ব্যক্তি ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন।
আরও পড়ুন
সরেজমিন পরিদর্শন ও কর অফিস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, কর অঞ্চল-৩ এর আওতায় এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬০ করদাতা ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন। যেখানে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ই-টিআইন নিবন্ধন নিয়েছিলেন ৪ লাখ ৫০ হাজার করদাতা। ওই বছরে রিটার্ন দাখিল করেন ২ লাখ ৬৫ হাজার করদাতা। অর্থাৎ ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করে থাকেন। এই কর অঞ্চলের আওতায় M অদ্যাক্ষরের কোম্পানিগুলো নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে থাকে। এছাড়া ব্রিটিশ টোব্যাকো ও বেক্সিমকোসহ A থেকে F অক্ষরের কোম্পানিতে কর্মরত করযোগ্য আয় করেন এমন কর্মকর্তারা এই কর অঞ্চলের নিয়মিত করদাতা।
কর অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কর অঞ্চল-৩ এর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আহরণ হয় ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৫১৫ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা চ্যালেঞ্জিং হলেও রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে এনবিআরের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে বলেই মনে করছেন কর অঞ্চল-৩ এর কমিশনার কাজী লতিফুর রহমান।
জানা যায়, এই কর অঞ্চলের আওতায় মোট ২২ কর সার্কেল রয়েছে। কর অফিস ও বুথগুলোর করসেবার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং করদাতাদের অভিযোগ কিংবা যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য একজন অতিরিক্ত কর কমিশনারের নেতৃত্বে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে আয়োজিত মিনি কর মেলায় এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার ৫৫১ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন, যার মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
পৌনে ৬ লাখ ই-টিআইএনধারীদের কর সেবা দেওয়া ও তাদেরকে আয়করের জালে আনাসহ করদাতাদের কাঙ্ক্ষিত করসেবা দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ কর ভবনের সীমিত স্থান ও জনবল সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের তিনটি সার্কেল অফিস ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়িতে হওয়ায় স্থান সংকট রয়েছে। সে কারণে জেলা পর্যায়ের সার্কেল অফিসগুলো অন্তত নিজস্ব ভবন থাকা জরুরি।
অন্যদিকে লোকবল সংকটের বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পৌনে ৬ লাখ টিআইএনধারী করদাতাকে যদিও করের আওতায় যথাযথভাবে আনা যায় এবং কর সেবা দিতে হয় তাহলে অবশ্যই জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। সেখানে কর অঞ্চল-৩ এর কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ২৬৭ জন থাকার কথা থাকলেও সে সংখ্যক কর্মকর্তা নেই বর্তমানে। কর অফিসটিতে ৫৫ জন কর্মকর্তা ও ১৬৭ জন কর্মচারী মিলিয়ে ২২২ জন কর্মরত রয়েছেন। যা ২২ সার্কেলের করদাতার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়াও রয়েছে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব।
সার্বিক বিষয় জানতে চাইলে কর অঞ্চল-৩ এর কর কমিশনার কাজী লতিফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই কর অঞ্চলের আওতাধীন ঢাকার বাইরে তিনটি সার্কেল অফিস রয়েছে। বাকি সার্কেলগুলো ঢাকাতেই রয়েছে। প্রতিটি সার্কেলে কর তথ্য সেবা মাস উপলক্ষ্যে বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে। বুথের সামনেই অভিযোগ বক্স রয়েছে। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করছি আমরা। ৩০ নভেম্বরের পরেও আয়কর রিটার্ন দেওয়া যাবে, তবে ট্যাক্স রিবেট ও কর অব্যাহতিসহ বেশকিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন করদাতারা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিআইএনধারী সব করদাতা যাতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, সেজন্য আমাদের আওতাধীন প্রতিটি অফিস প্রধানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে আমরা সব করদাতাকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে অনুরোধ করেছি। এখন পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দাখিলের চাপ তুলনামূলকভাবে কম। যত সময় যাবে করদাতাদের ভিড় বাড়বে। তাই আমি অনুরোধ করবো শেষ দিনের জন্য অপেক্ষায় না থেকে, হয়রানি এড়াতে যত দ্রুত সম্ভব রিটার্ন দাখিল করেন। আবার কোনো করদাতা যদি অনলাইনেও রিটার্ন দাখিল করতে চায়, সেই সেবা দিতে পৃথক বুথ রয়েছে, করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারবে।
অন্যদিকে রিটার্ন দাখিল করতে আসা সাব্বির নামের এক করদাতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেলার পরিবেশে কর অফিসে রিটার্ন জমা দিলাম। সারা বছর আমরা এই সেবা পেতে চাই। অভিজ্ঞতা ভালো-মন্দ মিলিয়ে।
কর অঞ্চলের কোনো সমস্যা বা অভিযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর সেবার মান আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। হয়রানি এখনো আছে। তবে অফিসেরও জনবল সংকট রয়েছে বলে মনে করি। একটি অফিসের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সার্কেল অফিস থাকার কারণে অনেক নতুন করদাতা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বিষয়টি সমাধানের অনুরোধ করব।
কর অঞ্চলগুলোতে যেসব সেবা মিলছে
>> প্রতিটি অফিসে উন্মুক্ত স্থান বা কার পার্কিং এরিয়ায় রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিলকারী করদাতাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেওয়া হচ্ছে।
>> অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।
>> সব কর কমিশনার সেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। থাকছে এ-চালান গ্রহণ বুথ।
>> সব কর অঞ্চলের কমিশনাররা তাদের নিজ নিজ কর অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
>> ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৪টি কর অঞ্চলে কেন্দ্রীয়ভাবে ও অন্য সব কর অঞ্চল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যথাযথ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে জেলা ও সিটি করপোরেশনভিত্তিক সেরা করদাতা সম্মাননা প্রদান করবে।
আরএম/জেডএস