বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। ফলে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকা মান হারাচ্ছে। এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ক‌মে গে‌ছে ৫০ পয়সা। চলতি অর্থবছরে চার মাসে টাকার দরপতন হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা, আর এক বছরে কমেছে প্রায় ১০ টাকা।

সবশেষ বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১১ টাকা। এক‌দিন আ‌গে বুধবারও এক ডলারে ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এ নিয়ে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের ষষ্ঠবারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলো। অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাইয়ে ডলারের দাম ছিল ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা এবং এক বছর আগে গত নভেম্বরে ছিল ১০১ টাকা ৩৮ পয়সা।  

নভেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিকারকদের থেকে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো। আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৪ টাকা। গেল মাস অক্টোবরে ১১০ টাকায় ডলার কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রির সিদ্ধান্ত ছিল।

তবে ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে। ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়। শিক্ষার্থী, রোগী ও পর্যটক বিদেশে যাওয়ায় সময় নগদ ডলার কিনতে গেলে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে।

টাকার মান কমলে সমস্যা কোথায়?
ডলারের বিপরীতে টাকার মান যখন কমে যায় তখন বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের চাপ বাড়ে। এক বছরের যদি ডলারের দাম ১০ টাকা বাড়ছে। তার মানে আগের তুলনায় এখন বিদেশি ঋণ সরকারকে ১০ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে ভর্তুকির পেছনে ব্যয় ও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।

মুদ্রার মান নির্ধারণ হয় অর্থের ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে। দ্রব্যের দামের সঙ্গে মুদ্রার মানের সম্পর্ক বিপরীত। দ্রব্যের দাম কমলে মুদ্রার মান বাড়ে, বিপরীত-ক্রমে দ্রব্যের দাম বাড়লে টাকার মান কমে। যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থের আন্তর্জাতিক মূল্য নির্ধারিত হয় তার জোগান এবং চাহিদার ওপরে নির্ভর করে।

এদিকে ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমছে টাকার মানও। ডলার বাঁচাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। যদিও মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং নিষ্পত্তির হার কমেছে। এতে উৎপাদন খাত শিথিল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেই চলেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দি‌য়ে‌ছে। যে কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে  ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ।

২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ (২৬ অক্টোবর) কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭০ কোটি (২৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক হিসাবপদ্ধতি ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬)’ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৮৯ কোটি (২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) ডলার।

এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো কষ্টকর। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন নেতিবাচক। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

এসআই/এসএম