আর্থিক সংকট নিরসনে ডলারের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। কিন্তু এবিবি ও বাফেদা দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে দামে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এই মডেল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই একবারে না পারলেও আস্তে আস্তে বৈদেশিক মুদ্রার দর বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

অর্থনীতিবিদদের সাথে মতবিনিময় প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন নীতিসমূহ ব্যাখ্যা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় অংশ নিয়ে জাহিদ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।  

এছাড়াও ঋণ সুদহার ক্রমান্বয়ে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণপূর্বক তা সংরক্ষণের নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে নীতি সুদহার একক বিনিময় হার, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সাশ্রয়ের উল্লেখপূর্বক ভবিষ্যতে সময়োপযোগী নীতি উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি তাকে অবহিত করে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। এই নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

বৈঠক শেষে ড. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানানো হয়। সামনে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এ বিষয়ে আমাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। আমরা সবাই জানি চ্যালেঞ্জগুলো কী। ঋণের সুদের হার, ডলার মার্কেটে অস্থিরতা এবং ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ এখন সবচেয়ে বড় বোঝা। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী নীতির আরও পরিবর্তন আসতে পারে।

তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে তিনটি জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে, সুদহারের নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার দর ও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ কমানো। এর মধ্যে আমরা কিছু পরামর্শ দিয়েছি। তা হলো, এবিবি ও বাফেদার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন একবারে যদি নাও পারি ধাপে ধাপে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ইতোমধ্যে ঋণের সুদের হার স্বাভাবিক করার জন্য স্মার্ট পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ঋণের হার পদ্ধতি আরও সহজ করার পরামর্শ দিয়েছি আমরা। ডলার বাজার স্বাভাবিক করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ ছাড়া যে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণগুলো ছিল সেগুলো ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন বাস্তবায়ন করাটা খুব জরুরি।

এর আগে গত সোমবার গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে সংস্থাটি জানায়, ডলার সংকট নিরসনে সম্প্রতি নেওয়া রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দীর্ঘ মেয়াদি সুফল আসবে না। ডলার রেট পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেছিলেন, আমরা জানিয়েছি দেশের অর্থনীতি এখন একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখন যদি সঠিক পদক্ষেপ বা নীতি গ্রহণ করা না হয় তাহলে আগামীতে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে।  

আলোচনার মূল বিষয় ছিল বর্তমান সমস্যা ও এটি সমাধানে করণীয় কী? এ সময় মূল্যস্ফীতি, বাজার ভিত্তিক ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট, সুদহার, অর্থপাচার ও খেলাপি ঋণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে—জানান ড. সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচার বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়বে না। যারা অর্থ পাচার করছে তাদের তথ্য কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই?

এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলো, কারা পাচার করছে তাদের আইডেন্টিফাই করা যায়। তবে তথ্য প্রমাণ না থাকায় আইনের আওতায় আনা যায় না। 

এ বিষয়ে আমরা (সানেম) দ্বিমত প্রকাশ করেছি, কারণ যদি পাচারকারীদের আইডেন্টিফাই করা যায় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের যে বিশেষ সংস্থা আছে তারা যদি ইচ্ছে করে পাচারকারীদের তথ্য প্রমাণ বের করা কঠিন হওয়ার কথা না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জোর দিয়েছি। কারণ অর্থ পাচার বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়বে না।

বর্তমানে খেলাপি ঋণের যে অঙ্ক দেখানো হচ্ছে এটা আসলে সঠিক নয়, বাস্তবে আরও অনেক বেশি; খেলাপি মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশ হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন বলে জানান— ড. সেলিম রায়হান।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি চাপে দেশ। সঙ্গে চলছে তীব্র ডলার সংকট। বাজেট ঘাটতি অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই সমাধান খুঁজতে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞসহ খাত সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে সহায়ক হতে পারে বিবেচনায় অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।

প্রথমে গত ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে একই বিষয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেদিন নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। কেননা এ ধরনের প্রবণতা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে।

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজারে লাগাম টানার আগে ‘মূল্য প্রত্যাশা’র লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছি। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছি।

এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ। ‘পণ্যের দাম বাড়বে—এমন প্রত্যাশা যখন স্থায়ী হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেঁধে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং মূল্য প্রত্যাশা কমাতে সমন্বিত ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি গ্রহণ এবং তার মাধ্যমে বাজারে সংকেত দিতে হয়। এছাড়া দৃশ্যত যেখানে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে ওঠে, সেখানে তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর কথা বলেছি। 

এরপর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এর সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর। তার মতে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলে এমনিতেই ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান চলমান অর্থনীতির সংকট সমাধানে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বড়দের ঋণ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার জরুরি। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি’ গ্রহণ এবং খরচ কমানো দরকার। এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি  স্থিতিশীলতা বড় বিষয়।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে।

এসআই/এসকেডি