ন্যূনতম মজুরি
মালিকদের প্রস্তাব সাড়ে ১০, শ্রমিকরা চান ২৫ হাজার
>> ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক : মালিকপক্ষ
>> নতুন মজুরি বাড়ানো হবে নভেম্বরে : বোর্ডের চেয়ারম্যান
>> আগের ধারাবাহিকতা রক্ষায় চেষ্টা করব : সিদ্দিকুর রহমান
মালিকের ইচ্ছায় নয়, নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর কথা। সেই ধারাবাহিকতায় মজুরি বাড়ানোর আলোচনা চলছে। এ সংক্রান্ত সভা আগামী ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। সভায় শ্রমিকদের পক্ষের প্রতিনিধি ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করবেন। তবে, মালিক পক্ষ চাচ্ছেন নামমাত্র মজুরি বাড়াতে। সেক্ষেত্রে এটি সাড়ে ১০ হাজার টাকা হতে পারে। বর্তমানে একজন শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি হিসেবে আট হাজার টাকা পান।
অন্যদিকে, শ্রমিকদের বিষয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) শ্রমিকদের জীবন-মান মূল্যায়ন করে ন্যূনতম বেতন ১৭ হাজার ৫৬৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত হবে— এ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করা ২৫ সংগঠনের নেতারা ২০ হাজার টাকা বেশি রাখার প্রস্তাব করলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং কোনোভাবে জীবন চালিয়ে নিতে মজুরি ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করে। সেই প্রস্তাব লিখিত আকারে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
যদিও মালিকপক্ষ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারাও মনে করেন মজুরি বাড়ানো দরকার। তারপরও শ্রমিকদের দাবি হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। বলছেন, শ্রমিকদের দাবি অনেকটা ‘বন্দুক চাইলে কামান পাবে’— এমন ধারণা। তাদের দাবি পূরণ তো দূরের কথা, সিপিডির ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক— বলছেন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমইএ নেতারা।
মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান মূল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেতন বাড়তে পারে। তার চেয়ে বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু সিপিডির সাড়ে ১৭ হাজার টাকা এবং শ্রমিকদের দাবি করা ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকার মজুরি সম্পূর্ণ অবাস্তব। এ দাবি কোনোভাবে মানা সম্ভব নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রমিকদের হাত ধরে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। অথচ, সেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দিক থেকে শীর্ষ দশের মধ্যে নেই বাংলাদেশ। আরও হতাশার বিষয় হচ্ছে, পাশের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা বলছেন, পোশাক কারখানায় বর্তমানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা। অথচ জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্যের এ বাজারে একজন মানুষকে বেঁচে থাকতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। এখন আট হাজার টাকা চলে যায় ঘর ভাড়ায়। এরপর খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে।
আরও পড়ুন
‘প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার আছে। অধিকাংশ শ্রমিকের পরিবার চলে একজনের আয়ে। পরিবার নিয়ে দুই বেলা ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাই ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করা হয়েছে। দ্রুত এ দাবি না মানলে নির্বাচনের (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) আগে আন্দোলনে নামব’— হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন শ্রমিকনেতারা।
শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিকদের পক্ষে ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব আগামী ২২ অক্টোবর বোর্ডের কাছে তুলে ধরা হবে। আমরা এবার বাজার পরিস্থিতি সঙ্গে সমন্বয় রেখে ২০ হাজারের বেশি মজুরি রাখার প্রস্তাব করব। পাশাপাশি প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করব। এ ছাড়া, বর্তমানে সাতটি গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। সাতটি গ্রেড থেকে দুটি গ্রেড বাদ দিয়ে পাঁচটি গ্রেডে মজুরি দেওয়ার প্রস্তাব করব।
মালিকদের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেবে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্রস্তাবনা এখনও তৈরি করা হয়নি। তবে আশা করছি, আগামী সভার আগেই প্রস্তাবনা তৈরি করতে পারব।
ন্যূনতম কত টাকা রাখার প্রস্তাব রাখবেন— জবাবে তিনি বলেন, সেটি ২২ অক্টোবরই জানতে পারবেন। তবে, সিপিডি ও শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছে তা অযৌক্তিক। তাদের প্রস্তাবটি হলো এরকম যে ‘কামান চাইলে বন্দুক তো পাব’। সবার আগে দেশ ও সেক্টর। সবমিলিয়ে যেটা ভালো হবে সেটাই করা হবে। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে যে হারে বেতন বেড়েছে এবারও সেই ধারাবাহিকতায় মজুরি বাড়ানো হবে।
মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখতে হবে সেক্টরের কতটুকু সক্ষমতা আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর এখন নতুন করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এ ইস্যুতে বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নতুন মজুরি বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান।
২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি ২৭০০ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় আট হাজার টাকা। ২০১৩ সালে যা ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা।
নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন মাস্টার্স পাস করে মাত্র ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। পড়ালেখা না জানা একজন গ্রামের লোককে কেন ১৭ হাজার কিংবা ২৫ হাজার টাকা মজুরি দিতে হবে?
তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ বছরের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। তাতে বেতন ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করছি। সেই হিসাবে আট হাজারের সঙ্গে আরও ২৪০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু তার বেশি হলে অনেক মালিককে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।’
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালিক কিংবা শ্রমিকপক্ষ আগামী ২২ অক্টোবর সভায় তাদের প্রস্তাবনা দেবে। প্রস্তাবনাগুলো যাচাই-বাছাই ও গবেষণা করে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে।
আরও পড়ুন
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল সিনিয়র জেলা জজ লিয়াকত আলী মোল্লার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। ছয় মাস মেয়াদি বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয় গত ১১ অক্টোবর। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে মালিক কিংবা শ্রমিকপক্ষ কেউ মজুরি প্রস্তাব জমা দেয়নি। ফলে সরকার মজুরি বোর্ডের মেয়াদ বাড়িয়েছে। মজুরি বোর্ডের প্রত্যাশা, নভেম্বরের মধ্যে ন্যূনতম মজুরি চূড়ান্ত করা হবে।
অক্টোবরের মধ্যে যদি মজুরি প্রস্তাব না দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে কী করা হবে— জবাবে বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, তাহলে ২৩ থেকে ২৫টি সংগঠনের প্রস্তাবগুলোর সারসংক্ষেপ করব। পাশাপাশি ২২ অক্টোবরের আলোচনায় যে প্রস্তাব আসবে তা তুলে ধরে নভেম্বর মাসের মধ্যে খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়ন করবে।
আইন কী বলে
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ১৪১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সুপারিশ প্রণয়ন করা কালে মজুরি বোর্ড জীবন-যাপন ব্যয়, জীবন-যাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করিয়া দেখিবে।
সেই নিয়ম অনুসরণ করে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে জমা দেবে।
মজুরি ২৫ হাজার টাকা চায় টিইউসি
পোশাক শ্রমিকদের একটি বড় অংশের নেতৃত্ব প্রদানকারী শ্রমিক সংগঠনের নাম গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)। সংগঠনটির সভাপতি মন্টু ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত পাঁচ বছরে পোশাক খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে কথা বলার সংকট দূর হয়নি। এখন শ্রমিকরা মুখ খুলে কথাও বলতে পারে না।
প্রবীণ এ নেতা বলেন, সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দেওয়া হয় আমাদের শ্রমিকদের। বিশ্বজুড়ে পোশাক রপ্তানিতে আমরা যদি শীর্ষে থাকতে পারি, তাহলে মজুরির দিক থেকে সবার কম কেন? তাই বোর্ডের কাছে একটি যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণ করার আহ্বান জানান তিনি।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামীম বলেন, করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কয়েক বছরে দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে বাড়িভাড়াও। কিন্তু বাড়েনি কেবল শ্রমিকদের বেতন। তাই বর্তমান কাঠামোর মজুরি দিয়ে পোশাক শ্রমিকদের জীবন-যাপন করা অত্যন্ত কষ্টকর। এ মজুরি দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করছেন। আর প্রিয় সন্তানকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন অন্যের হাতে।
আরও পড়ুন
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ২৫ হাজার টাকার কমে এখন একটি পরিবারের পক্ষে জীবনধারণ করা সম্ভব নয়।
নির্বাচনের আগেই নতুন মজুরি চান শ্রমিকরা
শ্রমিকদের আরও একটি বড় সংগঠন হলো- বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইলও প্রায় একই মত পোষণ করেন। বলেন, নির্বাচনের আগে মজুরি না বাড়ানো হলে আমরা নির্বাচন বর্জন করব। দেশের পোশাক-শ্রমিকরা নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থাকবে। পোশাক-শ্রমিকদের ভোট আদায় করতে হলে দ্রুত ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব জানান তিনি।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ছিল আট হাজার টাকা। ডলারের দাম বাড়ার কারণে গত পাঁচ বছরে দেশে জিনিসের দাম অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দুই-তিন গুণ হয়েছে। বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করলে পোশাক-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করতে হবে।
তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে প্রতিটি শ্রমিকই ভয়াবহ কষ্টে দিন পার করছেন। তারপরও বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় অথচ নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে পারে না!
শ্রমিক সংহতির এ নেতা বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। এ সময় যাতে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মালিকরা একতরফা মজুরি নির্ধারণ করতে পারে। এটি যেন না হয়, আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে আমাদের দাবি আদায় করে নিতে হবে।
আরও পড়ুন
শ্রমিকনেতা জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মজুরি বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধির যিনি রয়েছেন, তিনিও মালিকদের হয়ে কাজ করছেন। তা না হলে মজুরি বোর্ডের তিনটি সভা হয়েছে। বোর্ডের বেঁধে দেওয়া সময় ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। বিদেশি-ক্রেতারা প্রতি পিস পোশাকে অতিরিক্ত সাত সেন্ট করে দিলে বাড়তি মজুরি দিতে কারখানার মালিকদের ওপর চাপ পড়বে না বলে মনে করে সিপিডি।
ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকার প্রস্তাব সিপিডির
দেশের বর্তমান সময়ে একজন শ্রমিকের (সদস্য তিনজন) পরিবারের জন্য মাসে খাবার বাবদ খরচ প্রয়োজন ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। খাবার ছাড়া অন্যান্য খরচ প্রয়োজন হয় ন্যূনতম ১২ হাজার ৮৮২ টাকার। সুতরাং শ্রমিকদের মাসিক নিম্নতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা হওয়া জরুরি বলে মজুরি বোর্ডের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডি বলছে, বায়াররা যদি প্রতি পিস পোশাকের জন্য মূল্য সাত সেন্ট করে বাড়িয়ে দেয় তাহলে প্রস্তাবিত বেতন দিতে মালিকরা কোনো প্রকার চাপে পড়বেন না।
আরও পড়ুন
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এক চতুর্থাংশ কারখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে তাদের আপত্তি নেই। শ্রমিকরা প্রত্যাশা করছেন ১৮ হাজার ২৮৮ টাকা। এদিকে, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের দাবি ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করা হোক।
৮ হাজার টাকা মজুরি আর কত দিন, প্রশ্ন রাষ্ট্রদূতের
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ মজুরি বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি সাধারণ পরিবারের জন্য আট হাজার টাকা মোটেও ভালো মজুরি নয়। মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্যোক্তা ও সরকারের পাশাপাশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের উপপ্রধান থিজ উডস্ট্রা বলেছেন, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশকে ন্যূনতম মজুরির ফাঁদ থেকে বের হতে হবে। এ অবস্থায় দেশের পোশাক-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আর কত দিন পর্যন্ত আট হাজার টাকা থাকবে, বর্তমানে এটিই জরুরি প্রশ্ন।
থিজ উডস্ট্রা বলেন, প্রবৃদ্ধির মডেল নিয়ে বাংলাদেশের পুনরায় চিন্তা করা প্রয়োজন। এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। ফলে বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের পোশাক খাতের ৪৫ লাখ শ্রমিকের কথা চিন্তা করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের পরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই।
পোশাকের মূল্য বাড়লে আমারও বেতন বাড়াব
পোশাক-শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সবকিছু বিবেচনা করেই আমরা প্রস্তাবনা জমা দেব। শিল্প থাকলে শ্রমিক থাকবে, শিল্প না থাকলে শ্রমিক দিয়ে কী হবে? মজুরি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে শিল্প বন্ধ না হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ুক, এটা আমরাও চাই। কারণ, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তবে, এটাও খেয়াল করতে হবে যে রপ্তানি অর্ডার কমে আসছে। ফলে এমন মজুরি নির্ধারণ করতে হবে যাতে তা দেওয়ার সক্ষমতা মালিকদের থাকে।
মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভা ২২ অক্টোবর
তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে নিম্নতম মজুরি আট হাজার টাকা। পোশাক-শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণে ছয় মাস আগে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। ইতোমধ্যে এ বোর্ডে তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত শ্রমিক বা মালিক কোনো পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। এ অবস্থায় আগামী ২২ অক্টোবর চতুর্থ সভার আহ্বান করা হয়েছে।
বোর্ডের প্রত্যাশা, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ উভয়ে ওই দিন প্রস্তাব জমা দেবে। এ বিষয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের অর্থনীতি, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে আমরা নতুন মজুরির প্রস্তাব চেয়েছি। দুই পক্ষই আগামী সভায় প্রস্তাব জমা দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে। আমি আশা করি, নতুন মজুরি-কাঠামো কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর। সেই কাঠামোতে শ্রমিকরা নতুন মজুরি হাতে পাবেন জানুয়ারিতে।
উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক-শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ১৯৯৪ সালে প্রথমবার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। সেই বোর্ড ৯৩০ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে। ২০০৬ সালে সেটি বাড়িয়ে করা হয় এক হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১০ সালের মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করে।
২০১৩ সালে মজুরি বোর্ড নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে মজুরি বোর্ড পোশাক-শ্রমিকদের জন্য আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি চূড়ান্ত করে। এর মধ্যে মূল মজুরি চার হাজার ১০০ টাকা। আগের বছরের ধারাবাহিকতায় এবার ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত।
এমআই/এমএআর/