ডলার সংকটে বড় হচ্ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি
ডলার সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এতে করে আর্থিক হিসাবে বড় হচ্ছে ঘাটতি। এই ঘাটতির কারণে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বুধবার ( ৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
বিজ্ঞাপন
মূলত আমদানিতে বিভিন্ন নীতিগত শর্ত দেওয়ার কারণে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা কমছে। চলতি হিসাবের পরিস্থিতিও উন্নতি হয়েছে। তবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে আর্থিক হিসাবে। এর মূল কারণ, যে হারে দেশে বিদেশি ঋণ আসছে তার চেয়ে বেশি আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয় বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় থেকে। এখানে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, পোর্টফলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইকুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।
আরও পড়ুন
ব্যাল্যান্স অব পেমেন্টের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ৮৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ সময় আমদানি হয়েছে ৯৮৬ কোটি ডলারের পণ্য। এতে করে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১০১ কোটি ২০ লাখ (১ দশমিক ১ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ১১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।
ডলার সংকট কাটাতে নানা উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুলাই থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। একইসঙ্গে তুলনামূলক কম প্রয়োজন বা বিলাসী পণ্যের এলসি খোলার সময় ৭৫ থেকে শতভাগ পর্যন্ত নগদ মার্জিনের শর্ত দেওয়া আছে। এ মার্জিনের টাকা দিয়ে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণও নেওয়া যাবে না। এছাড়া বড় এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তথ্য নিয়ে তার সঠিকতা যাচাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ডলার সংস্থান করা ছাড়া ব্যাংকগুলোকে এলসি খুলতে মানা করা হয়েছে। এর প্রভাবে গত অর্থবছরে আমদানি ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, রপ্তানি বেড়েছে ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এক হাজার ৭১৫ কোটি ৫০ লাখ (১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়। এর ধারাবাহিকতায় ঘাটতি নিয়েই শুরু হয়েছে চলতি অর্থবছর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যের আর্থিক হিসাবে ২০১ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঘাটতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ গুণের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ঘাটতি ছিল ২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক হিসাব ভালো রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই সূচকের ওপরই দেশের ঋণমান নির্ভর করে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। ঋণ দেওয়ার সময় বিভিন্ন শর্তজুড়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।
আরও পড়ুন
ঘাটতির কারণ হিসাবে কর্মকর্তারা জানান, আমদানি কমলেও আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় আসছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও আগের দেনা পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এ ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিশোধ ঝুঁকি এড়াতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভও ধারাবাহিক কমছে।
এ অবস্থা সৃষ্টির কারণ কী
গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। দুই বছরে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে ১ ডলার কিনতে খরচ হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা, ২ বছর আগে ছিল ৮৪-৮৬ টাকা। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এখন প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৪ টাকা আর খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকা।
এমন অবস্থায় ডলারের দাম সামনে আরও বাড়বে এই আশঙ্কায় দেশি উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। উল্টো আগের নেওয়া ঋণ শোধ করছে। অনেকে খরচ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় মেয়াদ বাকি রয়েছে, এমন ঋণও শোধ করে দিচ্ছে। এর ফলে গত দেড় বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাঠাতে হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় খুব বাড়েনি। হুন্ডি ও অর্থপাচারের কারণে রেমিট্যান্স নেতিবাচক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ফলে ডলার সংকট চরম আকার সৃষ্টি হয়েছে।
চলতি হিসাবের ভারসাম্য (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স)
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো।
সবশেষ তথ্য বলছে, জুলাই ও আগস্টে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ৮০ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই হিসাব ঘাটতি ছিল ১৪৬ কোটি ডলার।
ওভারঅল ব্যালেন্স
সামগ্রিক লেনদেনে (ওভারঅল ব্যাল্যান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সূচকটি আগের বছর একই সময় ঘাটতি ছিল ২২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
আলোচিত সময় ৩৫৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর একই সময় পাঠিয়েছিলেন ৪২২ কোটি ডলার। জুলাই-আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগ
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সামান্য বেড়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশ যেখানে ৯৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল। চলতি অর্থবছরে একই সময় এসেছে ৯৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।
আলোচিত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। এ সূচকটি আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছরে এ সময় নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
তবে আলোচিত সময় নিট বিদেশি বিনিয়োগ (বিবিধ) ২৩৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার কমে গেছে। যা আগের বছরে কমেছিল ৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
একইসঙ্গে আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্ট) এসেছে ৪ লাখ ডলার। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪ লাখ ডলার।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল গত জুনে প্রকৃত (নিট) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। শর্ত অনুযায়ী সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখা, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার রাখতে হবে।
এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী জুনে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার।
সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার আর বিপিএম ৬ অনুযায়ী আছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার।
এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসআই/এসকেডি