বেসরকারি খাতে ঋণ ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন
দেশে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। সর্বশেষ হিসাবে, চলতি বছরের জুলাইয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশে। আগের মাস জুনে যা ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
ব্যাংকার ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। সুদের হার কম হওয়ায় আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে আছে। এছাড়া বিভিন্ন সংকটে দেশে উৎপাদন কমেছে। নির্বাচনী বছরে সবাইকে ঋণ দিতে চাচ্ছে না ব্যাংক, আবার রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে যারা ঋণ নিতে চান, তাদের অনেককে ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। আবার যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক, তারা আপাতত ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ভাটা পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
অর্থনীতিবিদদের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণ কম যাওয়া মানে দেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যও কমে যাচ্ছে। দেশের কর্মসংস্থান ও সাধারণ মানুষের আয় কমছে। সংসারের জন্য ঋণ করা খারাপ হলেও অর্থনীতির জন্য ভালো, যদি ঋণের অর্থ ফেরত আসে।
আরও পড়ুন : শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতার কাছে জিম্মি ব্যাংক
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেসরকারি ঋণ কমে যাওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণ কমে যাওয়া মানে বিনিয়োগ কমে যাবে। যখন বিনিয়োগ কম হবে তখন কর্মসংস্থানও কমে যাবে এতে করে দারিদ্র বিমোচনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, দেশের পুঁজিবাজার এখনো বেসরকারি খাতের অর্থায়নের জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তাই এখনো বেসরকারি খাতে অর্থায়ন হয় ব্যাংক খাত থেকে। অনেক ব্যাংকে এখন পর্যাপ্ত তারল্য নেই। আবার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা ভেবে অনেকে ঋণ নিচ্ছে না। কারণ দেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আসতে আগ্রহী নন। কারণ এখন ঋণ নিয়ে যদি অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারে তাহলে সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। তখন খেলাপি হয়ে যাবে; শাস্তির মুখে পড়বে। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। চলতি অর্থবছরে সরকার বেসরকারি ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে তাও অর্জন করতে পারবে না বলে আমি মনে করি।
আরও পড়ুন : ১১ ব্যাংকের বেপরোয়া ঋণ, ‘ঝুঁকি’তে গ্রাহকের আমানত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ ৪৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু এর আগের মাসেও ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিল বেসরকারি খাত। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানেই ঋণ বিতরণ ৮ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা কমেছে। তবে আগের বছরের জুলাই মাসে যে ঋণ বিতরণ হয় তার চেয়ে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। কারণ ২০২২ সালের জুলাইয়ে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি কোটি টাকর ঋণ নিয়েছিলেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
ব্যাংকাররা জানান, যে কোনো ঋণের মোট অঙ্ক বা স্থিতির আগের বছরের সুদসহ হিসাব হয়। ফলে আগের বছরের তুলনায় প্রকৃত বা নিট ঋণের পরিমাণ কোনো বিতরণ ছাড়াই পরের বছর বৃদ্ধি পায়। সুদ যুক্ত হওয়ার পরেও এবার বেসরকারি ঋণ কমে গেছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে নতুনভাবে কোনো ঋণ বিতরণ হচ্ছে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে। সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গত বছরের মাসের কোনোটিতেই সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি ব্যাংক খাত।
আরও পড়ুন : রেকর্ড ব্যাংক ঋণ সরকারের, ‘দেউলিয়াত্ব’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা
তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগের মাস শেষে যা ১১ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি থাকলেও কমে যাচ্ছে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ। গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলারে নেমেছে। গত বছরের জুন শেষে যা ছিল ১ হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার। এর মানে ১ বছরে কমেছে ৪৩৭ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক শূন্য ৬১ শতাংশ।
এর আগে প্রায় প্রতি বছর ঋণ অল্প অল্প করে বাড়ছিল। বিশেষ করে করোনার মধ্যে ব্যাপক বেড়ে যায়। ২০২০ সাল শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ছিল ৯১৩ কোটি ডলার। এক বছরে ৬৩৩ কোটি ডলার বা ৬৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে ২০২১ সাল শেষে হয় ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের বাইরে গত মার্চ পর্যন্ত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ রয়েছে আরও ৮১০ কোটি ডলার। মূলত সুদ অনেক বেড়ে যাওয়া এবং নতুন ঋণ পাওয়া দুরূহ হওয়ায় বিদেশি ঋণ কমছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ডলারের সংকট চলছে। তাই ডলারের ওপর চাপ কমাতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমাতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বাজার সামাল দিতে গত অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের অর্থবছর বিক্রি করা হয় ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে বাজার থেকে প্রচুর অর্থ তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিল কমছে।
আরও পড়ুন : সংকটের সময়ও বাড়ছে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব
পদ্ধতিগত কারণে বাজার থেকে টাকা উঠে যাওয়া এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত হারে আমানত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নানা অনিয়ম ও বেনামি ঋণ নিয়ে লুটপাট করে খাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এসব তথ্য বেরিয়ে আশায় অনেকে ভয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রেখে দিয়েছেন। এতে করে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটিসহ আটটি ব্যাংক অনেক দিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না। জরিমানার টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না কোনো কোনো ব্যাংক। এসব কারণে বেশির ভাগ পণ্যের দর বাড়লেও ঋণ সেভাবে বাড়ছে না।
বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্য
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিয়েছে। গত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। তবে আগামী ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাতে ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ এবং আগামী জুনে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসআই/এসকেডি