জলবায়ু পরিবর্তন, ডেঙ্গু সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে সারাদেশে বাড়ছে সর্দি-জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। রোগ-বালাই আর রোগীর চাহিদাকে পুঁজি করে মাল্টা, কমলা, আপেলসহ সবধরনের ফলমূলের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে মাল্টার দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১০০ টাকা। ক্রেতারা বলছেন, যাদের পুঁজি করে মাল্টার দাম বেড়েছে; তারা (রোগী) যদি সেই দাম জানতে পারেন তাহলে ‘বেহুঁশ’ হওয়ার মতো অবস্থা হতে পারে!

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বৃদ্ধিতে নিজেদের কোনো হাত না থাকলেও সেটা নিয়ে ‘একটা পক্ষ’ অবশ্যই কলকাঠি নাড়ছে।

ক্রেতারা বলছেন, অসুখ-বিসুখ হলে ফলমূল কিনে খাওয়ার অবস্থা এখন নেই। বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাণিজ্যমন্ত্রীর উচিত পদত্যাগ করা।

বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কাওরানবাজারের ফলের বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে মাল্টা। এ ফলটি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজিতে। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা, আঙ্গুর বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, আনার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, দেশি সবুজ মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা, পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে।

অসুখ-বিসুখে ফলমূল খাওয়া কমেছে

বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতেগোনা কিছু বড়লোক আছে, যাদের কিনতে সমস্যা হয় না। কিন্তু গরিবের যে অবস্থা, অসুখ-বিসুখ হলে যে টুকটাক ফলমূল কিনে খাবে, সেই অবস্থা এখন নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে জ্বর সর্দি বেড়েছে, পরিচিত অনেকেই অসুস্থ। তাদের জন্য এক কেজি মাল্টা কিনে কেউ একজন রোগী দেখতে যাবে, সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, দামাদামি করে ১ কেজি মালটা নিয়েছি ৩৫০ টাকা দিয়ে। এই মাল্টাই আগে ১২০ টাকা করে মানুষ কিনত। এরপর দেখলাম ২২০ টাকা হলো, এখন আবার এক লাফে ৩৫০-৫৮০ টাকা পর্যন্ত হয়ে গেছে। মাল্টার পাশাপাশি আপেলের অবস্থাও প্রায় একই রকম। কী আর বলব ভাই, যাদের অফুরন্ত আয় রোজগার আছে, মাস শেষে বেতনের উপর যাদের ভরসা করে থাকতে হয় না, তাদের জন্য মাল্টা ৫০০ টাকা হয়ে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের।

মাসুদ আলম বলেন, ডেঙ্গু প্রকোপটা বাড়ায় ফল ব্যবসায়ীদের ঈদ লেগেছে। ১০০ টাকার ডাব ২০০ টাকা, এখন আবার মাল্টাতে নজর পড়েছে। বাজারে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু সরকারের যেন এদিকে কোনো নজরই নেই।

‘রোগীর জন্য ফল নিতে এসেছি, দাম শুনে কী করব বুঝতে পারছি না’

বাসায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রেখে কাওরানবাজারে ফল কিনতে এসেছেন বিমা কোম্পানিতে কর্মরত মো. মইনুল ইসলাম। ফলের দাম প্রসঙ্গে তিনি হাস্যরস করে বলেন, মাল্টা-কমলার যে দাম, রোগীর জন্য নিয়ে গেলে দাম শুনেই আবার বেহুঁশ হয়ে যেতে পারে!

আরও পড়ুন : নিজেদের সুরক্ষা আইনেও কেন ‘সুরক্ষাহীন’ চিকিৎসকরা?

ঢাকা পোস্টকে মইনুল ইসলাম বলেন, বাজারে ফলমূলের অসম্ভব দাম। আগে আমরা ১৮০ থেকে সর্বোচ্চ ২২০ টাকা দিয়ে মাল্টা কিনেছি। এখন সেই মাল্টা কিনতে হয়েছে ৩৮০ টাকা কেজি। এটা তো আসলে অসম্ভব দাম। দাম বেশি হলেও তো কিছু করার নেই। ডেঙ্গু রোগী বাসায়, তার জন্য বেশি দামে হলেও কিনে খাওয়াতে হবে। টাকার চিন্তা করে তো কোনো লাভ নেই।

বাড়তি দামের কারণ কী থাকতে পারে বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো তো সিন্ডিকেটের প্রভাব। ব্যবসায়ীরা অস্বীকার করলেও এখানে যে তাদের কারসাজি আছে, এটা সবাই বুঝে।

দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপে আপনি কতটা সন্তুষ্ট? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে শুধু ফলমূল নয়, প্রতিটি দ্রব্যেরই দাম বেড়েছে। বাজারে সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং তাগের কার্যক্রমে সন্তুষ্টির কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি বলব যে, বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে তার পদত্যাগ করা উচিত। হঠাৎ ফলমূলের দাম বেড়ে গেলো, বিষয়টি সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের নজরেই আসল না! এমনটি তো হওয়ার কথা না। অবশ্যই তাদেরও দাম বাড়ার পেছনে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকতে পারে।

সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধিতে অবাক ব্যবসায়ীরাও

ডেঙ্গুর অজুহাতে মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলমূলের দাম বেড়েছে, অকপটে বিষয়টি স্বীকার করেন কারওয়ান বাজারের ফল ব্যবসায়ী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে কেজি প্রতি মাল্টার দাম বেড়েছে ১০০ টাকা পর্যন্ত। গত ৭ থেকে ১০ দিন আগেও মালটা বিক্রি করেছি ২৮০ টাকা কেজি, বর্তমানে মাল্টা বিক্রি করছি ৩৮০ টাকা করে। নতুন নতুন দাম দেখে আমরাও অবাক হচ্ছি।

আরও পড়ুন : এনার্জি ড্রিংকস : ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

তিনি বলেন, আমাদের আসলে কিছু করার নেই, প্রতি কার্টুন মাল্টা কিনে আনতাম ৩৪০০ থেকে ৩৫০০ টাকা করে, আজকে কিনে এনেছি ৫৬০০ টাকা কার্টুন। আহামরি খুব একটা লাভ করি, তা কিন্তু নয়। কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা লাভেই বিক্রি করে দিই।

এই বিক্রেতা আরও বলেন, মাল্টার প্রভাবে কমলার দামটাও বেড়েছে। এখন ৩৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছি, যা এক সপ্তাহ আগেই ২৫০ টাকা করে বিক্রি করেছি। এছাড়া আনারের দামটা আগের মতোই আছে, তবে সবুজ আর লাল আপেলের দামটা একটু বেড়েছে। লাল আপেল আমরা কিনে এনেছি ৫৪০০ টাকা কার্টুন।

সব ফলেরই দাম বেড়েছে

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রায় প্রতিটি ফলের দামই বাড়তি। তবে তুলনামূলক কম দামে বিক্রি হচ্ছে পেয়ারা। যদিও সেটাও গতবছরের তুলনায় বেশি বলে জানিয়েছে ফল বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম।

আরও পড়ুন : চিকিৎসক সংকট কাটাতে আসছে ‘বড় নিয়োগ’

তিনি বলেন, গত বছর ৪০-৫০ টাকা করে কিনতাম, ৬০/৭০ টাকায় বিক্রি করতাম। এ বছর ৬০/৭০ টাকা করে কিনে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। ফলমূলের দাম বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য সকল জিনিসের দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখছেন এই বিক্রেতা।

রফিকুল ইসলাম বলেন, এক সপ্তাহ আগেই লাল আপেল বিক্রি করেছি ২৮০ টাকা কেজি, এখন বিক্রি করছি ৩২০ টাকা কেজি। গ্রিন আপেলের দামটা তুলনামূলক কিছুটা কম, বর্তমানে বিক্রি করছি ৩৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহে আগে বিক্রি করেছি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। ছোট সাইজের আপেল বিক্রি করছি ২৮০ টাকা কেজি। এক সপ্তাহ আগে কমলা বিক্রি করেছি ২৮০ টাকা কেজি, বর্তমানে বিক্রি করছি ৩৪০-৩৫০ টাকা কেজি করে।

‘ফলমূল পচনশীল না হলে দাম থাকত পাহাড় সমান’

ফলমূল পচনশীল হওয়ায় আড়তদাররা এটিকে মজুত করে রাখতে পারেন না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা।

তিনি বলেন, একটা ভালো বিষয় হলো, আড়তদাররা চাইলেই ফলমূল বেশি দিন মজুত করে রাখতে পারেন না। যদি সেটা সম্ভব হতো, তাহলে দেখতেন দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে! এ বিক্রেতা বলেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। গত বছর যদি কেজিতে ৫ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল, এ বছর হচ্ছে ১০ টাকা। আমাদের তো কিনে এনে দামে পোষাতে হবে।

আরও পড়ুন : স্যালাইন, ডাব ও মাল্টার দাম বাড়িয়ে ডেঙ্গু রোগীদের ‘জিম্মি’

দাম বৃদ্ধিতে আড়তদারদের কোনো প্রভাব আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছুটা প্রভাব তো থাকেই। তাদের থেকে বেশি দামে কিনতে হয় বলেই আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।

দাম বাড়লেও কমেনি চাহিদা

মাল্টার দাম বাড়ায় বিক্রিতে কোনো প্রভাব পড়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ফল বিক্রেতা মজিব খান বলেন, বিক্রি বরং আগের তুলনায় বেড়েছে। আগে কিনত এক কেজি করে, এখন একেকজন এসে নিচ্ছে ৫-৬ কেজি। জানি না কেন যেন দাম বাড়ায় চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। আগে মাল্টা আনতাম একসাথে ৫ কার্টুন, আজকে ২০ কার্টুন এনেছি, তারপরও একদিনেই প্রায় শেষ।

দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, কেন দাম বাড়ছে সেটা বলতে পারব না, এটা জেনে রাখেন যে, আগেও আমরা কেজিতে ১০ টাকা লাভ করেছি, এখনো সেই ১০ টাকাই লাভ করছি। যখন ১২০ টাকা মাল্টা বিক্রি করেছি, তখনও ১০ টাকা লাভ হয়েছে, আর এখন যে ৩৭০-৩৮০ টাকা বিক্রি করছি, সেই ১০ টাকাই লাভ হচ্ছে। দাম বাড়িয়ে আমরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছি, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। এখন বরং আমাদের এই লাভের পেছনে বেশি টাকা ইনভেস্ট করতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, যে কেউ চাইলে আমাদের চালান, ম্যামো দেখতে পারেন, কত টাকা দিয়ে কিনে এনেছি, কত টাকায় বিক্রি করছি, সবই ওপেন (খোলামেলা)। এখানে কোনো লুকাচুরির সুযোগ নেই। যে আপেল আগে আনতাম ২৮০০ টাকা কার্টুন, সেটি এখন আনছি ৫৩০০ টাকা করে। দামের এত পার্থক্য হল কেন, সবচেয়ে ভালো আমদানিকারকরা বলতে পারবে।

আরও পড়ুন : সুপার হাসপাতালে ‘সুপার’ অনিয়ম, ৬৬ কোটি টাকার অডিট আপত্তি

বাজারে আপেল-মাল্টা মজুত হয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এ বিক্রেতা বলেন, ফল জাতীয় কোনো জিনিসই বেশিদিন মজুত করে রাখার সুযোগ নেই। এখনো যে মজুত করে রেখেছে তা নয়, বরং বাজারে সংকট আছে। আজকে মাল্টার জন্য ফোন দিয়েছি, তারা বলছে মাল্টা নেই। যদি পাই, তাহলে প্রয়োজনে আরও ২০০ টাকা বেশি দিয়ে আনব। আনলেই দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

জ্বর সর্দি হলেই মাল্টা-ডাবের বাধ্যবাধকতা নেই : এবিএম আবদুল্লাহ

সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এই যে, দাম যতই হোক ডেঙ্গু বা জ্বর সর্দি হলে মাল্টা কিনে খেতে হবে। তবে বিষয়টিকে 'বাধ্যবাধকতা নেই' বলে মনে করেন দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলেই ডাব, মাল্টা খেতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বলা হয়ে থাকে এই সময়টাতে একটু লিকুইড (তরল) জাতীয় খাবার বেশি খেতে। তার মানে এই নয় যে, মাল্টা আর ডাবই খেতে হবে। ডেঙ্গুতে মাল্টা-ডাবের কোন সাইন্টিফিক রুল নেই। যেকোনো তরল জাতীয় যেকোনো খাবার খেলেই হলো। এক্ষেত্রে পানিও খাওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ অনেকটা হুজুগে প্রকৃতির। কেউ কিছু একটা বললে সবাই এটাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এই সুযোগটাই সব সময় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে ডেঙ্গুতে ডাবের উপকারিতার কথা উঠে আসায় দাম হয়ে গেছে দ্বিগুণ। এখন আবার মাল্টার দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সবই আসলে ব্যবসায়ীদের কারসাজি।

তিনি আরও বলেন, আমি বলব, জ্বর বা ডেঙ্গুতে ডাব, স্যালাইন, মাল্টাসহ কিছু নির্দিষ্ট করা ফলমূল অপ্রয়োজনীয়, সুতরাং অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এ জাতীয় ফল খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তরল জাতীয় খাবারের জায়গায় পানি, কোমল পানীয়-জুস, এমনকি বাসায় তৈরি করে স্যালাইনও খেতে পারেন।

টিআই/এসকেডি