তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য উদঘাটন করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া ও পানামায় এসব অর্থ পাচার করা হয়।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১০টি প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমডিএস ফ্যাশন, হংকং ফ্যাশন লিমিটেড, থ্রি-স্টার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড, স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স।

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) শুল্ক গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচালক শাসমুল আরেফিন খান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক যোগসাজশে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। ইএক্সপির কার্যকারিতা না থাকায় বৈধ পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ মানিলন্ডারিং সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অভিযুক্ত ১০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

শাসমুল আরেফিন আরও বলেন, এর আগেও শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একই পন্থায় ৩৭৯ কোটি টাকা পাচারের ঘটনা উদঘাটন করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অনুসন্ধানসহ ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৬৭৯ কোটি টাকা পাচারের ঘটনা উদঘাটন করল শুল্ক গোয়েন্দা।

শুল্ক গোয়েন্দা জানায়, রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্যচালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না এমন একটি অভিযোগ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কাছে ছিল। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেম (ইএক্সপি) ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। যার বিপরীতে কোনো অর্থ দেশে ফিরে আসেনি বা সমুদয় রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।

তদন্তকালে ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে ১ হাজার ২৩৪টি পণ্যচালানে এমন জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ ১ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন, যার বিপরীতে ফেরতযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার সম্ভাব্য পরিমাণ ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৮ মার্কিন ডলার। প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানসমূহ টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট, প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি দেখিয়ে অর্থ পাচার করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বিল অব এক্সপোর্টের কোড ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। ১০ প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্ট ও ইএক্সপি তথ্যের মধ্যে মিল পাওয়া যায়নি এবং সাউথ ইস্ট ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত ১০ প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই ওই ব্যাংকে লিয়েন করা নয়।

প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড
সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড ২০১৯ সালে ৩৮৩টি ও ২০২০ সালে ৮টিসহ ৩৯১টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছ। রপ্তানি করা পণ্যচালানগুলোতে ৩ হাজার ৮০ মেটন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার বা ৯২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা প্রায়। প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের কোম্পানি এমএজে শিপিং কর্পোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, অ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জেজে অ্যাসোসিয়েট ও এক্সপ্রেস ফরোয়ার্ডারস।

ফ্যাশন ট্রেড

রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬ ও ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ ২৪৯ রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। রপ্তানি করা পণ্যচালানগুলোতে ১ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফলিপাইন, নাইজরেমি, সঙ্গিাপুর, অস্ট্রলেয়িা, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্টের নাম এমজে শিপিং কর্পোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল এবং এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

এম ডি এস ফ্যাশন

ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত এমডিএস ফ্যাশন নামের প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানি করা পণ্যচালানগুলোতে ১ হাজার ৩৭৬ মে. টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার ও ফিলিপাইন রপ্তানি কথা বলেছে। যার মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার বা ৪৪ কোটি ১ হাজার ৫৫১ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হলো চট্টগ্রামের এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন ও পান বেঙ্গল এজেন্সি।

হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড

গাজীপুরের টঙ্গিতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ১৫৬টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে।  তার ১ হাজার ৯৬১ টন টি-শাট রপ্তানি করা কথা বলেছে। অধিকাংশ পণ্যচালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, কাতার, নাইজেরিয়া, কুয়েজ, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানির মাধ্যমে ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন ডলার বা  ৪০ কোটি  ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওযা গেছে। জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট এম এ জে শিপিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, পরাগ এসএমএস লিমিটেড, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল ও একে ইন্টারন্যাশনাল।

থ্রি-স্টার ট্রেডিং

ঢাকার বনানীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ১২০টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। রপ্তানি করা পণ্যচালানগুলোতে ৮১৬ মে. টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস, কানাডা, মিসর প্রভৃতি দেশে রপ্তানির নামে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার বা ২৫ কেটি ৯২ লাক ৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হলো জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, আর এস সি অ্যান্ড এফ লিমিটেড, ও এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

ফরচুন ফ্যাশন

ঢাকার মিরপুরের ঠিকানার প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ এবং ২০১১ সালে ৫৯টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে। ৪৩৫ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস, মিশর, কানাডা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার বা ১২ কোটি ৯৪ লাখ  ৫৯ হাজার ৬২৩ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। জড়িত সি এন্ড এফ এজেন্ট রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল,এ এন্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও এম/এস এ. কে এন্টারপ্রাইজ।

অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড

রাজধানীর কচুক্ষেতের ঠিকানাধারী প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। পণ্যচালানগুলোতে ১৯৫ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানির বিপরীতে প্রায় ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার বা ৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হলো পান বেঙ্গল এজেন্সি, এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জে জে অ্যাসোসিয়েট, জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন ও এন এইচ কর্পোরেশন।

পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড

গাজীপুরের টঙ্গিতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ২০টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করে ১৭০ মে. টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত, ফিলিপাইনস, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি দেখিয়ে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার বা ৫ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হলো জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন ও এন এইচ কর্পোরেশন।

স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড

রাজধানীর শাহবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানি চালান জালিয়াতি করে ৬৬.৮ মে. টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। অধিকাংশ পণ্যচালান ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, পানামা প্রভৃতি দেশে রপ্তানির বিপরীতে প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার বা ২ কোটি ১৭ লাখ ২ হাজার ৯০২ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হলো জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি ও কে আর এস সি অ্যান্ড এফ লিমিটেড।

ইডেন স্টাইল টেক্স

রাজধানীর খিলক্ষেতের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ৮টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। ৪২ টন টি-শার্ট ওমান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ মার্কিন ডলার বা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা পাচার করেছে। রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সি এন্ড এফ এজেন্ট হলো জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি ও কে আর এস সি এন্ড এফ লিমিটেড।

আরএম/এসএসএইচ/এসএম