ইটের বিকল্প চাহিদা মেটাচ্ছে ‘মীর কংক্রিট ব্লক’
কুচি-পাথর, সাধারণ বালু, সিলেটের বালু, স্টোন ডাস্ট ও সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি কংক্রিট ব্লকের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। মাটি পুড়িয়ে তৈরি লাল ইটের চেয়ে এটি পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে আবাসন থেকে শুরু করে নানান নির্মাণ কাজে এখন এই কংক্রিট ব্লকের চাহিদা তুঙ্গে।
দেশের ১০০টির বেশি কংক্রিট ব্লক তৈরির প্রতিষ্ঠান থাকলেও ৪টি লিডিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হয়ে ইটের বিকল্প হিসেবে চাহিদা মেটাচ্ছে মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেড।
বিজ্ঞাপন
পরিবেশ রক্ষায় আগামী ২০২৫ সাল থেকে লাল ইটের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। সরকারের সেই ধারাকে অব্যাহত রাখতে কাজ করছে মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেড। ব্লকের জন্য তারা এক ইউনিট থেকে ২টি ইউনিট তৈরি করেছে। এজন্য গত ১৩ আগস্ট একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেডের ইউনিট-২ ঘুরে দেখা গেছে, একটি ফুল অটোমেটিক ব্লক প্রসেসিং ইউনিট চায়না থেকে আমদানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যার মূল্য ১০ লাখ ডলার। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুরাপাড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগর গ্রামে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৬ বিঘা জমির উপর এটি স্থাপন করা হয়েছে।
এখানে এখন তৈরি হচ্ছে মীর সলিড কংক্রিট ব্রিকস, মীর হলো ওয়াল ব্লক, ইউনি পেভিং ব্লক, রেক্টেংগুলার পেভিং ব্লক, কার্ভ স্টোন ও অন্যান্য ব্লক এবং পেভমেন্ট টাইলস ক্যাটাগরির ৩৫টি আইটেমের কংক্রিট ব্লক। মেশিন অপারেট ছাড়া সব আইটেম তৈরি হচ্ছে হাতের স্পর্শ ছাড়া।
বুয়েট সার্টিফাইড মীর কংক্রিট ব্লক ব্যবহার করে নির্মাণের খরচ লাল ইটের চেয়ে তুলনামূলক কম। কংক্রিট ব্লকের দেয়ালের গাঁথুনিতে সিমেন্ট-বালু কম লাগে। এটি ব্যবহারে ভবনের ওজন কম হয় ও ভবন নির্মাণের সময়ও কম লাগে। কংক্রিটের হওয়ায় এটি মজবুত হয় এবং নির্মাণের স্থায়িত্ব বাড়ে। লাল ইটের মতো এতে নোনা ধরে কম। এছাড়া শব্দদূষণ ও তাপ পরিবহনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে ৪০ শতাংশ কম থাকে। ব্লকের তৈরি দেওয়ালে শুধু রং দিয়েই ফিনিশিং দেওয়া যায়। এতে খরচও কমে। বাইরের প্রাচীরে ব্লক গাঁথুনির মাধ্যমে বৈচিত্র্যও আনা যায়।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মীর কংক্রিট ব্লক আরও পরিবেশ-বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী তৈরির পরিকল্পনা করছে, যেন ২০২৫ সালের মধ্যে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। সবাই কংক্রিট ব্লক ব্যবহারে আগ্রহী হলে দেশের জন্য পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজতর হবে। এছাড়া কংক্রিট ব্লকে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটির।
এ বিষয়ে মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেডের প্ল্যান্ট ইনচার্জ (প্রোডাকশন ও অপারেশন) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমত বাজারে আমাদের ব্লকের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী আমরা প্রথম ইউনিট দিয়ে সরবরাহ করতে পারছিলাম না। কারণ, মেশিনেরও একটা ক্যাপাসিটি আছে। দ্বিতীয়ত আমাদের কিউডিং জোন ছোট ছিল। ফলে একদিনে যদি ৭০ হাজার পিস উৎপাদন হয় এবং সেটি যদি ডেলিভারি না হয় তবে আমাদের কিউডিং জোন আরও ছোট হয়ে আসবে। তারপর দিন যদি আরও ৭০ হাজার উৎপাদন হয় তাহলে আর জায়গা দিতে পারবো না।
তিনি বলেন, মূলত কিউডিংয়ে জন্য জায়গা প্রয়োজন হয়। শুরুতে এত জায়গা ছিল না আমাদের। পরে ম্যানেজমেন্টকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হই যে আমাদের জায়গা প্রয়োজন এবং আরও একটি ইউনিট করা গেলে ভালো হয়। ম্যানেজমেন্ট আমাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ২৬ বিঘা জমি দিয়েছে। সেখানে আমরা দ্বিতীয় ইউনিট তৈরি করেছি। জায়গা বেশি হওয়ায় আমরা এখন ৫ দিন কিউডিং করে ডেলিভারি করতে পারছি।
মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেডের হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী- বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩ হাজার ৫০০ কোটি পিস মাটি থেকে পোড়ানো ইট উৎপাদন হচ্ছে। এতে ১২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি জমির আবাদ নষ্ট করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ৫৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। এতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারের ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি। সরকার ঘোষণা করেছিল, ২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার; ২০২০-২১ সালে ২০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার; ২০২১-২২ সালে ৩০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার; ২০২২-২৩ সালে ৬০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার; ২০২৩-২৪ সালে ৮০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার এবং ২০২৪-২৫ সালে ১০০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিত করবে। বর্তমানে আমরা আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়িয়েছি। সরকারের দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠনে যে ভূমিকা আছে, সেখানে আমরা মীর কংক্রিট ব্লক কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, নতুন প্রযুক্তির ফলে আগের চেয়ে তিনগুণ প্রোডাকশন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আমরা প্রতিদিন দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার পিস সলিড ব্লক তৈরি করতে পারি। এই মুহূর্তে বাজারে যে পরিমাণ চাহিদা আছে, আমরা চেষ্টা করছি সেটা পূরণ করার। আমাদের আরও টার্গেট আছে। সামনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু ফ্যাক্টরি প্রতিস্থাপন করব। ইউনিট-২ তে সাড়ে দশ লাখ ডলার মূল্যের মেশিনারিজ প্রোডাক্ট আছে। একইসঙ্গে বিশ কোটি টাকা মূল্যের ইনফ্রাস্ট্রাকচার রয়েছে।
মীর কংক্রিট প্রোডাক্টস লিমিটেডের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে 'মীর কংক্রিট ব্লক লিমিটেড' ২০০৯ সালে কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটির পণ্য এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প, হাতিয়া উপজেলায় ভাসানচর প্রকল্প (রোহিঙ্গা ক্যাম্প), আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র (পূর্বাচল), হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে।
স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে মীর কংক্রিট ব্লক আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। সম্প্রতি ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের কাছ থেকে যে ১০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে তা পরিবেশবান্ধব পণ্য, যেমন- কংক্রিট ব্লক, কংক্রিট ইট, হলো ব্লক, ফুটপাথের টাইলস, ব্লক ইউনিট ইত্যাদি উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এমএইচএন/এমজে