ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বুধবার (৫ জুলাই) এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে ও জুন মাসের আমদানি বিল বাবদ ১০৯ কোটি ডলার পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।

এর আগে গত মে মাসে আকুতে ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। এ কারণে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। ওই অংক গত ৭ বছরে সর্বনিম্ন ছিল। এর আগে ২০১৫-১৬  অর্থবছরে রিজার্ভ ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছিল।

আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এছাড়া করোনার পর বৈশ্বিক বাণিজ্য আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে; যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এ সূচকটির ধারাবাহিকতা কমছে। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডলার সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে, আইএমএফের শর্ত মেনে ডলারের বাজারভিত্তিক দর কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বাড়বে আমদানি ব্যয়, প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিনের ডলার সংকট ও টাকার অব্যাহত অবমূল্যায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বাংলাদেশকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন চৌধুরী মঙ্গলবার (৪ জুলাই) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা আকুর (মে- জুন) আমদানি বিল বাবদ ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার বুধবার পরিশোধ করা হবে। এ অর্থ রিজার্ভ থেকে পরিশোধ হবে। বর্তমানে (সোমবার পর্যন্ত) রিজার্ভ আছে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আগামীকাল আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবারও কমে ৩০ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে (বিপিএম-৬) রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হয়, তাহলে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। সেই হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ নেমে দাঁড়াবে ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এ রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।

আকু কী?

আকু হলো- একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। তবে এখন আকুর সদস্য পদ নেই শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন যাবত আমদানি ব্যয় পরিশোধের বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির আকু সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।

রিজার্ভ যেভাবে তৈরি হয়

রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর ক‌রোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলাররে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ তে  ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার এবং সব শেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের আলোকে বাজারভিত্তিক দরে ডলার বিক্রি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ সোমবার (৩ জুলাই)  বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে আগের মূল্যের চেয়ে দুই টাকা ৮৫ পয়সা বেশি দামে অর্থাৎ ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সায় ৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বিক্রি করে।
এর আগে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ধারাবাহিক ডলার বিক্রির ফলে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি সঞ্চয় করা রিজার্ভ এখন ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাব থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসেবটাই প্রকাশ করে আসছে।

তবে সারা বিশ্বে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত বিভিন্ন তহবিলের পাশাপাশি বিমানের জন্য প্রদত্ত ঋণ গ্যারান্টি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব খাতে বর্তমানে রিজার্ভ থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার দেওয়া আছে।

এসআই/এসকেডি