দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতির চাপ ও বিনিয়োগে নানা শর্তের কারণে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়েনি। এ কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে; তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধে বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে এ খাতে নীতি বিনিয়োগ ঋণাত্বক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে আছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন বেশিরভাগ গ্রাহক। তবে এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। এ কারণে বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বেশি করতে হচ্ছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো তিন হাজার ২৮ কোটি ৭১ টাকা সরকার কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আলোচিত সময় (জুলাই-মে) ৭৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৭৮ টাকা। সব মিলিয়ে ১১ মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কোনো ঋণ পায়নি। উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের চাপে মূল ও মুনাফাসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরে একক মাস হিসাবে মে তে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার। বিপরীতে ওই মাসে মূল ও মুনাফা বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। মে মাসে নিট বিক্রি হয়েছে ৫৫১ কোটি টাকা।

৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা হয়। এছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডেটাবেস তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।

বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনও তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।

অতি মাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়েছে। যার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্বক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে এবার বাজেটের ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করছে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

এসআই/এসকেডি