ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিলেও ট্যাক্স দেয় না
দেশের অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ফেসবুক ও গুগলসহ ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। তারা ভ্যাট দিলেও ট্যাক্স দিচ্ছে না। সেজন্য ফেসবুক, গুগলের মতো টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে দেশে নীতিমালা প্রয়োজন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে এমন অভিমত তুলে ধরেন প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা। শনিবার (২৯ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ট্যাক্সিং দ্য ডিজিটাল ইকোনমি : ট্রেড-অফস অ্যান্ড অপরচুনিটিস’ শীর্ষক এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রধান অতিথির বক্তব্যে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ঠিকই ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের শ্যাডো বাংলাদেশে আছে, বডি কিন্তু নেই। এ কারণে তাদের ধরা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ফেসবুক-গুগলের মতো বড় কোম্পানি এ দেশে আসছে। এদের ও ট্যাক্সেশনের বিষয় আসছে। সেখানেও রাজস্ব আদায়ের বড় সুযোগ আছে। আইএমএফের প্রোগ্রামে আমরা ঢুকেছি। সেখানে কিছু টার্গেটও দেওয়া আছে। তিন বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার নতুন ট্যাক্স মোবিলাইজেশন আমাদের করতে হবে।
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইটির ২৮টি খাতকে আমরা আয়কর অব্যাহতি দিয়েছি। এগুলোর এফেক্টিভনেস আছে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত। এগুলো নিয়ে এখন ভাবার সুযোগ রয়েছে। দেশের অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ফেসবুক, গুগলের মতো ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। তারা ভ্যাট দিলেও ট্যাক্স দিচ্ছে না। এটা নিয়ে সারা বিশ্বেই আন্দোলন হচ্ছে।
দেশের ডিজিটাল ইকোনমির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার ২০২২ সালে ছিল ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন, যা ২০২৬ সালে সাড়ে ১০ বিলিয়নে পৌঁছাবে। ইক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ই-কমার্স প্লাটফর্মের সংখ্যা ২৫০০, যার মধ্যে ৯৫ শতাংশের আকার ছোট। সাড়ে চার হাজারের মতো সফটওয়্যার কোম্পানি আছে, চারশর বেশি প্রতিষ্ঠান ৮০টির বেশি দেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করছে। ৩৬ হাজার ৮০০ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে আমরা বিশ্বে ৮ম। ফেসবুক, গুগল কিংবা ইউটিউবে এড রেভিনিউ থেকে কত টাকা আয়, সেটার সঠিক হিসাব নেই। ২০২৭ সালে ওটিটির গ্রাহক ১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ডিজিটাল ইকোনমি থেকে রাজস্ব বাড়ানোর সুপারিশ তুলে ধরে সিপিডির এ সম্মানীয় ফেলো বলেন, ট্রান্সপারেন্টভাবে এটাকে নিয়ে আসতে হবে। নতুন নতুন সার্ভিসেস কোড নেই, রাজস্বের জন্য নতুন কোড আসবে। রাজস্ব বোর্ডকে অটোমেশন বাড়াতে হবে। রাজস্ব বোর্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পেপল দেশে আনা উচিত। এফ কমার্সের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক নেই, সেটাও করতে হবে। ন্যাশনাল স্টার্টআপ পলিসি দরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে। অর্থনীতির একটা বড় অংশ ডিজিটাল ইকোনমি হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে ট্রানজেকশনগুলো এত ছোট, এখানে যদি প্রত্যেকটাতে ট্যাক্স বসাতে চান সেখানে জটিলতা আসবে। শেষে ভোক্তা পর্যায়ে দিতে গেলেও ১০ রকমের সমস্যা আসবে। এখানে বিজনেস মডেল পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসছে। নিয়মনীতির ভিত্তিতে এই বিজনেস মডেল আনতে হবে। এখানে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা আনতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এই ইস্যুটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা আইএমএফের ঋণ সহায়তা প্রোগ্রামে রয়েছি। যে সমাধানগুলো বলা হয়েছে তার মধ্যে তিনটা আইএমএফের শর্তের পরিপূরক। একটা ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়াতে হবে। হাফ পারসেন্ট করে বাড়াতে হবে। কীভাবে বাড়বে এটা আমরা জানি না।
প্যানেল আলোচনায় বেসিসের পরিচালক হাবিবুল্লাহ নিয়ামুল করিম বলেন, ডিজিটাল ইকোনমি আলাদা কোনো ইকোনমি না। ভবিষ্যতে প্রথাগত ইকোনমির সঙ্গে ডিজিটাল ইকোনমির এই পার্থক্যটা আর থাকবে না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভ্যাটের আওতায় নেই। ৯০ শতাংশের বেশি ই-কমার্স ভেন্ডর ৮০ লাখ টাকার নিচের ফ্লোতে আছে। ই-কমার্সের ওপর যদি ভ্যাট আরোপ করি তাহলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের খুব বেশি সমস্যা হবে না। ক্রস বর্ডার ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে ফেসবুক, গুগল ছাড়াও অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের কাছ থেকেও রাজস্ব আদায় করা দরকার। ফেসবুক, গুগলকে বাংলাদেশে অফিস করতে বাধ্য করতে হবে।
ইক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন বলেন, ই-কমার্স যত এগিয়ে যাবে ডিজিটাল ইকোনমির সম্প্রসারণ দ্রুত হবে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার ছিল ৭০০ কোটি টাকার মতো। তখন ভারতে ইউনিকর্ণ তৈরি হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিকাশের মতো একটা ইউনিকর্ণ বা বড় কোম্পানি তৈরি হয়েছে। আমাদের ১০-২০টার বেশি ইউনিকর্ণ তৈরি হলে ট্যাক্স আদায় সম্ভব হবে। ট্যাক্স না দেওয়ার মন-মানসিকতা থেকে মানুষের বেরিয়ে আসা দরকার। ডিজিটাল ইকোনমিতে সব টাকা শনাক্ত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজীবা রহমান বলেন, একটা ফ্রিল্যান্সার আসলে দেশের ডিজিটাল রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমরা ২০২১ সাল থেকে কর অব্যাহতি পেয়েছি। তার আগে থেকে আমরা ১৯ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে আসছি। একটা ফ্রিল্যান্সারকে নিজেকে প্রমোশন করে কাজ পেতে হয়। সেখানে ডেবিট বা ক্রেডিট থাকতে হয়, যার মাধ্যমে টাকাটা খরচ হয়। সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ট্যাক্স ব্যাংকগুলো অটো পায়। ফেসবুক বা গুগল থেকে আয় করার পর আরও ১৫ শতাংশ অ্যাড হয়। তার মানে একজন ফ্রিল্যান্সার অলরেডি ট্যাক্সেশনের ভেতর থাকে। আয়ের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ দেশে আমরা নিয়ে আসতে পারি। কষ্ট করে খেটে ১০০ টাকা আয়ের মধ্যে মাত্র ৩০ টাকা ঘরে নিয়ে আসতে পারি। তারপর আর কত টাকা ট্যাক্স, ভ্যাট দিলে বলব আমরা প্রপার চ্যানেলে আছি, সেটা আমরা জানি না।
আরএম/এসএসএইচ/