কর অস্বচ্ছতাকে দুই ভাগ করা হয়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানো। যার কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এর পরিমাণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হতে পারে। ওই ফাঁকি রোধ করতে পারলে ট্যাক্সের আওতা বৃদ্ধি ও কর অব্যাহতি দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

সোমবার (৩ এপ্রিল) ‘করপোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা : বাজেটে সরকারি আয়ের অভিঘাত’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ তথ্য তুলে ধরেন।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কর অস্বচ্ছতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানো। কর ফাঁকি দিতে গিয়ে কোম্পানি তার প্রকৃত আয় কম দেখিয়ে থাকে। অন্যদিকে কর এড়ানোর বিষয়টি হলো লিগ্যাল ফ্রেমের আওতায় সরকারের দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দৃষ্টিতে এটাও কর অস্বচ্ছতা।’

আরও পড়ুন >> বছরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রাজস্ব ফাঁকি ৮৪ হাজার কোটি টাকা

‘কর ফাঁকি যদি ৮০ শতাংশ হয়, তাহলে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছি। আবার যদি কর ফাঁকি ৫০ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে রাজস্ব হারায় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এটি রোধ করা গেলে ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো আমাদের বাড়তি কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে।’

অন্যদিকে কর এড়ানোতে যে ব্যয় হচ্ছে সেটি যদি ৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয় তাহলে এর পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সরকার পাচ্ছে না। কর স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। যা সরকার পেলে স্বাস্থ্যখাতের বাজেটে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি করার সুযোগ ছিল, বলেন তিনি।

কর ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তা ও অডিটরদের সঙ্গে কথা বলে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা হলো, কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাত্রা ব্যাপক। কেউ কেউ বলছেন, ট্যাক্স লস যেটি হচ্ছে কর এড়ানোর জন্য সেটি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আর কর লস যেটি হচ্ছে কর ফাঁকির জন্য সেটা ১৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এটা খুব কঠিন একটা পূর্ণাঙ্গ তথ্য বলা। কেউই এটা বলেনি যে বাংলাদেশে কর ফাঁকি হচ্ছে না। 

মোয়াজ্জেম বলেন, কর অব্যাহতি নির্দিষ্ট সময় ও লক্ষ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। আর্থিক খাতের সব লেনদেন সমন্বিত হওয়া দরকার। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট ইন্টিগ্রেট হওয়া উচিত। এর অংশ হিসেবে ডিজিটালাইজেশন ও ইন্টারনেট ভিত্তিক ট্রানজেকশন হওয়া উচিত। কর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলক সাস্টেনেবল রিপোর্টিংয়ে যাওয়া দরকার। 

এ সময় করপোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে তিনি বলেন, গবেষণাটি যৌথভাবে সম্পন্ন করেছে সিপিডি ও খ্রিষ্টান এইড। ১২ জন অডিটরস ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। ট্যাক্স জাস্টিস রিপোর্ট বলছে- কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাধ্যমে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার কর ক্ষতি হচ্ছে। যার মধ্যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মাধ্যমে ৩১২ বিলিয়ন ডলার ও ব্যক্তি পর্যায়ের মাধ্যমে ১৭১ বিলিয়ন ডলার কর ক্ষতি হচ্ছে। এর অভিঘাত স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মধ্যে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে করপোরেট ট্যাক্স হার কমে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে বেড়েছে। করপোরেট কর হার কমিয়ে কর জাল বাড়িয়ে ট্যাক্স আদায় করা দরকার। করহার বাড়ানোর ফলে প্রচুর কালোটাকা থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করপোরেট ট্যাক্সে রেট দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে সর্বোচ্চ। কিন্তু ট্যাক্স জিডিপি রেশিও আফগানিস্তানের পরে সর্বনিম্ন। পার্সোনাল ও সেলস ট্যাক্স কম না, কিন্তু সেটা আমরা নিতে পারছি না। উচ্চ করহার প্রদান করেছি ঠিকই, কিন্তু তার যে সুফল সেটা আমরা ভোগ করতে পারছি না। আবার কর কমিয়ে দিলেও রাজস্ব বাড়ে, সেটারও নিশ্চয়তা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় ট্যাক্স জিডিপি রেশিও এবং করহারের মধ্যে ফারাকটা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।

সিপিডির গবেষণায় বলা হয়, ৬৮ শতাংশ মানুষ করযোগ্য আয় করার পরও আয়কর দেন না। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর দেওয়ার যোগ্য হওয়ার পরেও কর দেয় না। বিপুল পরিমাণ কর আওতার বাইরে থেকে যাওয়া, এটা কিন্তু একটা মাথাব্যথার কারণ ট্যাক্স জিডিপির ক্ষেত্রে। কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি না হওয়ার বড় কারণ এটি। অন্যদিকে জয়েন্টস্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্ট্রার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার ৩০ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে করের পরিমাণ ছিল ২০১০ সালে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ছায়া অর্থনীতিতে ৮৪ হাজার কোটি টাকা কর ক্ষতি হচ্ছে। যা জিডিপি’র প্রায় ৩০ শতাংশ। এই টাকা যদি পাওয়া যেতো তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিনগুণ বৃদ্ধি করা যেতো। অর্থ্যাৎ করনেট বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে প্রধান অপ্রাতিষ্ঠানক খাত। বড় অংশই করের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে কর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে।

আরএম/জেডএস