ঘাটতির বৃত্তে এনবিআর, পিছিয়ে ২৩ হাজার কোটি
রাজস্ব সংগ্রহে ভাটার টান কাটছে না কিছুতেই। সময় যতই যাচ্ছে বড় ধরণের ঘাটতির মুখোমুখি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) আট মাসে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। ৮.৯২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে আছে এখনো ৪৭.০২ শতাংশ।
এর আগে জানুয়ারি পর্যন্ত ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতির বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়ার কারণে বড় ধরণের সংকটের মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজ্ঞাপন
সংকট উত্তরণে প্রতিষ্ঠানটির আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগ থেকে নতুন নতুন উদ্যোগের কথা বলা হলেও ফলাফল মিলছে পুরো উল্টো। যদিও করোনা মহামারি পরবর্তী চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে রাজস্ব সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা বলছেন, অর্থ বছরের শুরুতে অতিরিক্ত আমদানিতে রাজস্ব সংগ্রহে ইতিবাচক প্রভাবে সন্তোষজনক জায়গায় ছিল এনবিআর। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে সীমাবদ্ধতায় সেখানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগের সাময়িক হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ দশমিক ৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ২২ হাজার ৯৭৮ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে ৪৭.০২ শতাংশ। আর আট মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৮.৯২ ভাগ।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি সাথে আমাদের রাজস্ব আহরণের সরাসরি সম্পর্ক থাকার কথা নয়। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা যদি ঠিক রাখা যায়, তাহলে ভ্যাট আদায়ও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। আর একটি বিষয় হচ্ছে রপ্তানি। বৈশ্বিক কারণে এ সেক্টরে প্রভাব পড়তে পারে। তবে এর সঙ্গে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, দেশের ভেতরে রাজস্ব আদায়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যেমন- করের আওতা বৃদ্ধি করা, কর বৈষম্য ও কর ফাঁকি দূর করা ইত্যাদি। যেটা এনবিআর পারবে কী না সেটাই বড় প্রশ্ন? কর আদায়ের সক্ষমতা যদি বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বলব এনবিআরের এমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
অন্যদিকে এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে এনবিআর থেকে বাড়তি কিছু আশা করা ঠিক না। এতকিছুর পরও বলব, এনবিআরের রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক। কারণ আমাদের লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ অর্জিত হচ্ছে। আগামীতে ঘাটতি অনেক কমে যাবে।
রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটের আদায় হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ খাতে আদায় হয়েছে ৭৬ হাজার ৪০১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি ১৫.০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ঘাটতি হয়েছে ৫ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
এরপরের অবস্থান আয়কর ও ভ্রমণ করের। এ খাতে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৬০ হাজার ৪৩৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৭৫৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা পিছিয়ে আছে।
একই সময়ে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ১৯৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। ঘাটতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৮১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধিও সবচেয়ে কম মাত্র ৪.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ আমদানি ভাটা পড়ার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়েও।
চলতি বছরে এনবিআরকে বিদায়ী অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। বিদায়ী অর্থবছরে সবমিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। ঘাটতি ছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১১ হাজার কোটি, মূসক আদায়ে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং আয়কর খাতে ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। পুরো অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাকি চার মাসে এনবিআরকে আরও প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে।
আরএম/এফকে