হলমার্ক কেলেঙ্কারির ‘হোতা’ হুমায়ুন অবৈধ সম্পদেও ফাঁসছেন
সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আলোচিত মহা-জালিয়াতির নাম হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্ক গ্রুপের এমন জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির।
এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যা আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ডজনের বেশি মামলার প্রধান আসামি হুমায়ুন। আদালতের রায়ে একটি মামলায় ১৭ বছর সাজাও হয়েছে তার।
বিজ্ঞাপন
দুদকের খাতায় পলাতক সেই হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে এবার অবৈধ সম্পদের মামলার প্রস্তুতি চলছে। সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আসামি করে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তবে সম্পদের পরিমাণ কম হওয়ায় আপাতত মামলার আসামি করা হচ্ছে না। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
আরো পড়ুন >> যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিমের ১৪ বাড়ির খোঁজে নেমেছে দুদক
এ বিষয়ে সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নাম প্রকাশ না শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির কর্মরত থাকাকালীন হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। আমি যতটুকু জানি হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটনায় অন্তত ১১টি মামলার অভিযোগপত্রে অন্যতম প্রধান আসামি তিনি। বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। যেহেতু পলাতক, তাই অনুসন্ধানকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর আর দুদকের ডাকে সাড়া দেননি কিংবা তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
আরো পড়ুন >> গোলাপের ৯ বাড়ি : আদালতের নির্দেশনা মেনে অনুসন্ধান করবে দুদক
তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানকালে তার নিযুক্ত করা এক অ্যাডভোকেট সব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট সরবরাহ করেন। হুমায়ুন কবির সোনালী ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের পর ‘ফারমার্স ব্যাংকে’ যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক মাস চাকরি করার পর ‘হলমার্ক’ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক নিয়মিত মামলা ও অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও বাস্তবে ওই সম্পদের মূল্য বেশি রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সাবেক এমডি মো. হুমায়ুন কবির ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে সুদীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরি জীবনে বিদেশ ট্রেনিং ও সোনালী এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছর চাকরি করেছেন। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও কর্মসংস্থান ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে আয়েশা বেগম রীতার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী আয়েশা বেগম রীতা প্রথম জীবনে টিউশনি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন বলে আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন। যদিও পেশার ঘরে গৃহিণী লেখা রয়েছে। তার নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের বেশিরভাগ তার স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ দ্বারা অর্জিত। বর্তমানে মিরপুরে নির্মিত ৬ তলা বিশিষ্ট বাড়ির ভাড়ায় জীবনধারণ করছেন।
হুমায়ুন কবিরের সম্পদের বিবরণ
আলোচিত চরিত্র সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, নিজ নামে ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৬৯২ টাকার স্থাবর সম্পদ ও নগদ স্থিতিসহ ৬০ লাখ ২৬ হাজার ৭৭০ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬২ টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়া যায়।
সম্পদ বিবরণীতে গৃহ নির্মাণ ঋণ হিসাবে ৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭৪ টাকা দায় দেনা আছে। আর হুমায়ুন কবীরের ২ কোটি ৪৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ টাকার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ মোট অর্জিত সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ১২৫ টাকা।
দুদকের অনুসন্ধানে হুমায়ুন কবীরের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৩ কোটি ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬ টাকা। এক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৯ টাকা বেশি পাওয়া যায়। যা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জিত বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী আয়েশা বেগম রীতার দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার নিজ নামে ৫২ লাখ ৯৯ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৫৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৯৯ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৫ টাকার সম্পদের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে আয়েশা বেগম রীতার ১ কোটি ১৬ লাখ ৯৪ হাজার ১০১ টাকার সম্পদের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ রীতার ৮৫ হাজার ৬৩৪ টাকার বেশি সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্পদের পরিমাণ কম পাওয়ায় মামলার সুপারিশ থেকে বিরত থেকে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক ফারুক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো বক্তব্য না দিয়ে জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মে পর্যন্ত জালিয়াতির মাধ্যমে ২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদক।
অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪ সালে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় দুদক। তবে নন-ফান্ডেড প্রায় ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকার দুর্নীতি অনুসন্ধান এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি।
২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১ মামলা এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফান্ডেড প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আরও ২৭ মামলা দায়ের করে দুদক। পরে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
যেখানে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের আসামি করা হয়।
হলমার্ক গ্রুপের মোট কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩। এর মধ্যে ২১টিকে ঘিরেই সোনালী ব্যাংকের সব পাওনা রয়েছে। এগুলো হলো- হলমার্ক ফ্যাশন, হলমার্ক ডিজাইন ওয়্যার, ওয়াল মার্ট ফ্যাশন, ইসলাম ফ্যাশন, ডন অ্যাপারেল, ফারহান ফ্যাশন, মাহমুদ অ্যাপারেল, হলমার্ক স্পিনিং, ববি ফ্যাশন, হলমার্ক ডেনিম কম্পোজিট, ববি ফ্ল্যাট বেড প্রিন্টিং, হলমার্ক অ্যাক্সেসরিজ, হলমার্ক নিট কম্পোজিট, ববি ডেনিম কম্পোজিট, হলমার্ক স্টাইল, পারফেক্ট এমব্রয়ডারি, হলমার্ক প্যাকেজিং, জিসান নিট কম্পোজিট, হলমার্ক নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, আনোয়ার স্পিনিং ও ম্যাক্স স্পিনিং। শেষের দুটি কারখানা মূলত হলমার্কের সৃষ্টি করা বেনামি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি কারখানার বিপরীতে প্রাপ্ত দেনা আদায়ে দেওয়ানি আদালতে মানিস্যুট মামলা করা হয়েছে
আরএম/এসএম