দুইদিনের সাপ্তাহিক ছুটিকে (শুক্রবার ও শনিবার) কেন্দ্র করে জমে উঠেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার নিয়ে মেলায় ঘুরতে আসছেন অনেকে। এবারের মেলায় দেশি-বিদেশি নানা পণ্যের পাশাপাশি ক্রেতা-দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে কারাগারে বসে কয়েদিদের হাতে তৈরি বাঁশ, বেত, কাঠ, পাট আর প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েদিদের তৈরি পণ্য-সামগ্রীর স্টল ‘কারা পণ্য, বাংলাদেশ জেল’-এ দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। দামে কম, মানে ভালো এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় সবাই পছন্দের পণ্য কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

আরও পড়ুন>>রপ্তানি বহুমুখীকরণে ভূমিকা রাখে বাণিজ্য মেলা

কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারাগারে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের আলোর মুখ দেখাতে কর্মদক্ষতা দিয়ে তৈরি করা হয়। তারা যেন শাস্তি শেষে বাড়ি ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে- সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ জেল কয়েদিদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের কাজ করাচ্ছে। বাণিজ্য মেলায় এসব পণ্যের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

ছোট্ট সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে কয়েদিদের বানানো নানা হস্তশিল্প ঘুরে দেখছেন ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত মোহাম্মদ আবদুল হাকিম। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মেলায় এসে সবচেয়ে ভালো লেগেছে কয়েদিদের বানানো এসব হস্তশিল্প দেখে। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি কারাগারেই কয়েদিদের কাজে লাগিয়ে দেশীয় শিল্পকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন>>জমেনি বাণিজ্য মেলা, চলছে সাজসজ্জার কাজও

আবদুল হাকিম বলেন, ছুটির দিনকে কেন্দ্র করে সবাই পরিবারসহ বাণিজ্য মেলায় আসছে, দেখেও ভালো লাগছে। আমিও মেলায় বাচ্চা পরিবার নিয়ে আসছি, প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখছি। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই কারা পণ্যের স্টলটি। এখানে যে পণ্যগুলো রয়েছে সবগুলো কয়েদিদের হাতে বানানো। কারাগারে বসেও কাজের মাধ্যমে কয়েদিরা আলোর পথ দেখছে, এটি খুবই ভালো বিষয়।

তিনি আরও বলেন, বন্দি অবস্থায় সময়টা কাটানো খুবই কষ্টের। এখন যেহেতু সরকার তাদের বিভিন্ন কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, কয়েদিরাও কাজের মাধ্যমে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারছে। এমনকি এসব হস্তশিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যটাকে তারা তুলে ধরছে। এজন্য আমি কয়েদিদের অনেক ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি আমি মনে করে প্রতিটি কারাগারেই সরকারের এই কার্যক্রমটাকে আরও গতিশীল করা দরকার।

আরও পড়ুন>>ছুটির দিনে লোকে লোকারণ্য বাণিজ্য মেলা, টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন

বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন মো. রিফাত হাসান। তার ভাষায়, মেলায় ঘুরতে এসে কয়েদিদের শিল্পকর্ম দেখে চোখ ফেরানো দায়। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জেলে যারা বন্দী আছে তাদেরকে সরকার কাজে লাগাচ্ছে এটি খুবই ভালো বিষয়। এতে করে তারা আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছে, সরকারের পুনর্বাসনও হচ্ছে। মেলায় অনেকক্ষণ ঘুরেছি, কিন্তু এই স্টলটায় এসে চোখ আটকে গেছে। মনে হচ্ছে সবগুলো জিনিসই আমি কিনে নিয়ে যাই।

পণ্যের মান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি পণ্যই আমি নিজ হাত ধরে দেখছি, খুবই ভালো মানের পণ্য এগুলো। কোয়ালিটির পাশাপাশি দামও তুলনামূলক কম। সবার সাধ্যের মধ্যেই। জেলে বসে কয়েদিরা এত ভালো পণ্য তৈরি করে এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। 

গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মেলায় ঘুরতে এসেছেন মাহমুদা সুলতানা। কয়েদিদের হাতে বানানো এসব পণ্যের সমাহার দেখে তিনিও আবেগে আপ্লুত। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশেই দীর্ঘদিন আমি থাকি। কিন্তু ভেতরে বসে কয়েদিরা কী করে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। মেলায় এই স্টলে ঘুরতে এসে অনেকটাই অবাক হয়েছি। নানা অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে বসে বন্দীরা এতো সুন্দর সব কাজ করছে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। সব মিলিয়ে খুবই ভালো লেগেছে স্টলটিতে ঘুরতে এসে।

তিনি বলেন, এখান থেকে বেশকিছু পণ্য আমি কিনেছি। আরও কিনতাম, কিন্তু নিয়ে যাওয়ার সমস্যা তাই আর কিনতে পারছি না। আবার যদি আসা হয়, আরও কিনবো।

বাংলাদেশ জেলের আইজি প্রিজন্সের স্টাফ অফিসার মো. জাকির হাসান রিয়েল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এবারের বাণিজ্য মেলায় আশাতীত সাড়া পাচ্ছি। এবার নিজেদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মানুষ আসছে। আমাদের স্টলে কাঠ, বাঁশ, বেত, পাটেরসহ নানা ধরনের পণ্য আছে। বিশেষ করে বাঁশের বেতের মোড়া, বেতের কোলা, ফুড কভার, নকশীকাঁথা, কাঠের টোল, সিংহাসন চেয়ারসহ প্রায় আড়াইশত ধরনের পণ্য আমাদের স্টলে আছে। 

তিনি বলেন, এসব পণ্য আমাদের কারাগারগুলোতে সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত যেসব বন্দী আছে তাদের হাতে তৈরি। তাদের জন্য আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। তারা সারা বছরজুড়েই এসব করে থাকে। যারা এই কাজে অভিজ্ঞ, পাশাপাশি দীর্ঘদিন কারাগারে আছেন এমন বন্দীরা নতুনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

মেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেখে শুনে পছন্দের পণ্যটি কিনতে ব্যস্ত ক্রেতারা। ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত স্টল ও প্যাভিলিয়নের বিক্রেতারা। ছুটির দিনকে কেন্দ্র করে স্টলগুলোতে রয়েছে নানা ছাড়ের সমাহার।

প্রসঙ্গত, এবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ১০টি দেশের ১৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। তবে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত মেলা চলবে। এবার মেলায় প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৪০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা। মেলার টিকিট অনলাইনে ক্রয় করলে ৫০ শতাংশ ছাড়ের সুযোগ থাকবে। 

এছাড়াও মেলায় প্রায় এক হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাসহ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৭টি প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টল রয়েছে। দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি হলের বাইরে মিলে মোট ৩৩১টি স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন রয়েছে।

টিআই/এমএ