ইত্তেফাক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক
এসডিজি অর্জনে সরকারি-বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করার আহ্বান
সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বেসরকারি খাতের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, দেশে বেসরকারি খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কোম্পানি সামাজিক দায়বদ্ধতা কমর্সূচির (সিএসআর) আওতায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এটি এসডিজির উদ্দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করলেও অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে তা করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এসডিজির সফল অর্জনে সরকারি এবং বেসরকারি খাতকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
রোববার (৩০ অক্টোবর) সকালে ইত্তেফাক আয়োজিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ইত্তেফাক কার্যালয়ের মজিদা বেগম মিলনায়তনে গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করা হয়।
দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি সাইদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজি অ্যাফেয়ার্সের মুখ্য সমন্বয়ক সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজ।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, যুগ্ম সচিব (এসডিজি অ্যাফেয়ার্স) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। আলোচক ছিলেন, বিএটি বাংলাদেশের হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স শেখ শাবাব আহমেদ, ইউনিলিভারের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স) শামীমা আক্তার, সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশনের (এমজিএইচ গ্রুপ) সহকারী পরিচালক বাশিরা হারুন, ইউএনডিপির চিফ টেকনিক্যাল এডভাইজার (স্ট্রেনদেনিং ইনস্টিটিউশনাল ক্যাপাসিটি ফর এসডিজিএস) ফখরুল আহসান, গ্লোবাল টেলিভিশনের সিইও এবং এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়শনের পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল আলম জুয়েল, দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজ বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে সবাইকে সমন্বিত উন্নয়নের আওতায় আনতে হবে। এসডিজিতে যেসব লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ সেগুলোতে আগে থেকেই কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। প্রান্তিক এবং দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর চাওয়াগুলো এসডিজির মূল বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কমিটমেন্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য অর্জনে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। একশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করা হচ্ছে।
প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বেসরকারি খাত যাতে তাদের ভূমিকা রাখতে পারে সেলক্ষ্যে সরকার তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে।
এসডিজি অ্যাফেয়ার্সের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম মূল প্রবন্ধে বলেন, এসডিজির কাজের শুরু আছে শেষ নেই। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য অর্জন শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের জন্য চ্যলেঞ্জের। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব লক্ষ্য অর্জন সহজ, সেগুলো অর্জনে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। মন্ত্রণায়লয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, এসডিজি অর্জনে বেসরকারি খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি খাতকে মুনাফার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
বিএটি বাংলাদেশের হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে আমরা ১১২ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছি। ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়েও আমরা সচেতন। এজন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মসূচি সরাসরি এসডিজির লক্ষ্য পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, বিএটি বাংলাদেশ মনে করে শুধু ব্যবসায় নয়, এর সঙ্গে জনগণের কল্যাণও জড়িত। সেজন্য বিএটি বনায়ন, সুপেয় পানি সরবরাহসহ পরিবেশ রক্ষায় বেশকিছু কর্মসূচি পালন করে চলেছে। তার মতে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের রিপোর্টিং নিশ্চিত করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এজন্য তিনি একটি পৃথক প্ল্যাটফর্মের কথাও উল্লেখ করেন।
ইউনিলিভারের পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশে আমরা ৬০ বছরের বেশি সময় কাজ করছি। ইউনিলিভারের সূচনা হয়েছে সামাজিক কমিটমেন্ট থেকে। ২৮টি ব্র্যান্ডের প্রত্যেকটিরই কমিটমেন্ট আছে।
তিনি বলেন, এসডিজির সঙ্গে পরিবেশের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইউনিলিভার পরিবেশ রক্ষায় নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ। প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এই কাজ শুরু হলেও পরে চট্টগ্রাম হয়ে এই কর্মসূচির ব্যাপকতা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, ইউনিলিভারে ৪২ শতাংশ নারী আছে। ফ্যাক্টরিতেও নারী আছে। শুধুমাত্র বাজার ব্যবস্থায় ওইভাবে নারীদের সম্পৃক্ত করতে পারেনি। প্রান্তিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক বাশিরা হারুন বলেন, আমরা বর্তমানে বেশকিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এর মধ্যে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। যা এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যের পরিপূরক। আমরা একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম চাচ্ছি। যেখানে সরকার থেকে নির্দেশনা থাকবে যাতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহজ হয়।
ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন হাসপাতালে সদ্যজাত শিশুর জন্য ৬টি ইনকিউবেটর স্থাপন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৪টি এতিমখানায় সহায়তা, কোভিডকালীন খাদ্য সহায়তা, রমজানে খাদ্য সহায়তা, গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শিশু শিক্ষা কার্যক্রম, ভালো কাজের হোটেল, বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) মেডিসিন ব্যাংক স্থাপন, অসহায় বিদেশি প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনা, ঢাকা মেডিক্যালে বার্ন ইউনিট আধুনিকায়ন উল্লেখযোগ্য। এগুলো সরাসরি এসডিজির সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইউএনডিপির প্রতিনিধি ফখরুল আহসান বলেন, এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে অবশ্যই বেসরকারি খাতকে আস্থায় আনতে হবে। কারণ বেসরকারি খাত হচ্ছে উন্নয়নের চালিকা শক্তি। তিনি বলেন, লক্ষ্য অর্জনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। উপজেলা থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কার্যক্রমে সমন্বয় থাকতে হবে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শুধু ব্যবসা করেই যাচ্ছে, কিন্তু বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যে কারণে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। দেশে কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় কল্যাণমূলক কর্মসুচি পালন করলেও অনেক প্রতিষ্ঠান অনুৎপাদনশীল কাজে যুক্ত। বেসরকারি খাতকে পরিবেশের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা সঙ্কাপন্ন।
সাংবাদিক জ ই মামুন বলেন, রুয়ান্ডার মতো দেশ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা প্লাস্টিক বর্জন করবে। মালদ্বীপেরও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ আমাদের এখানে এখনো এমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য অফিস সময় পরিবর্তন করেছে। কিন্তু এতে কতটুকু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলো তা কেউই বলতে পারে না। অনেক ভবনের জানালা নেই। বাতাস বের হওয়ার জায়গা নেই। এসডিজির ১৬ নম্বর লক্ষ্যে ন্যায় বিচারের কথা বলা হচ্ছে, এটির অবস্থা খারাপ। এর ওপর জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে বেসরকারি খাতের দায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়শনের পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সবাইকে এসডিজি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানি সিএসআরের কাজ করছে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করছে তারা আলোচনায় এলেও ব্যক্তিগত কাজগুলো আড়ালে থেকে যায়। তিনি একটি সুনির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যাতে সিএসআরের কাজ করা যায় সেইলক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা না পেলে এসডিজি কেন, কোন লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত হবে না। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা মধ্যে ১৬ নম্বরে রয়েছে- ‘শান্তি, ন্যায় বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান’। এই লক্ষ্যটি অর্জন করলে ১৭টি ধারাই অর্জন সহজ হবে। তাই সুশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলো এসডিজির মূল ভিত্তি। সরকারের যেমন এটা দরকার তেমনি বেসরকারি খাতেও বেশি প্রয়োজন।
এসএম