সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটবাবদ আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কাছে পাওনা ১৭৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা পরিশোধে বিশেষ ছাড় দিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বকেয়া কর আদায়ে কঠিন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাব স্থগিত করলেও দুই পক্ষের সমঝোতা ও করের আংশিক টাকা পরিশোধ করায় বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়িক কাজ পরিচালনায় আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সব ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার পাশাপাশি বকেয়া পরিশোধে কিস্তি সুবিধা দিতে সম্মতি দিয়েছে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (ভ্যাট)।

এর আগে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষেও প্রযোজ্য রাজস্ব পরিশোধ না করায় ১৯ সেপ্টেম্বর বকেয়া সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ওই চিঠিতে হিসাব স্থগিত করার পাশাপাশি হিসাবগুলোতে কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে, তার প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়। একই সঙ্গে সাত কর্মদিবসের মধ্যে করের অর্থ পরিশোধ না করলে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরাসরি এনবিআর-এ জমা হবে, এমন কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

এর পরপরই কোম্পানির প্রতিনিধি নথিপত্রসহ এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসে। অবশেষে আংশিক কর পরিশোধ করার পাশাপাশি কিস্তির মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের আবেদন করলে তা গ্রহণ করে ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) কমিশনার ওয়াহিদা রহমান সই করা চিঠি ৪৬টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে। 

ওই চিঠিতে বলা হয়, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কাছে মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১ এর আওতায় দাবি করা করের আংশিক পরিশোধ করে তার ট্রেজারি চালানের কপি পাঠিয়েছে। অবশিষ্ট রাজস্ব কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করার আবেদন করায় আগের জারি করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপরিচালনযোগ্য করার ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করা হলো। 

যদিও কোম্পানিটির হেড অব মার্কেটিং মাহিদুল ইসলাম দাবি করেছেন এটা এনবিআরের সঙ্গে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি। আলোচনায় ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়ায় এনবিআর ব্যাংক হিসাব খুলে দিয়েছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ওটা একটি ভুল বোঝাবুঝি। তারা ঠিকমতো বুঝতে পারে নাই। চিঠি ইস্যুর পর আমরা ভ্যাট বিভাগকে বুঝিয়ে বলায় তার বিষয়টি বুঝতে পেরে ব্যাংক হিসাব স্থগিতের চিঠিটা প্রত্যাহার করে নেয় এনবিআর।

আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, ফার্মফ্রেশ তরল দুধ এবং ফলের জুস উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানটি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের আওতায়, কর পরিশোধ করে আসছে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাজেটে এনার্জি ড্রিংকের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে যখন ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় তখন। ২০১৮ সালের ৭ জুন এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। যেখানে ২০১৮ সালের ৬ জুন বা তার পূর্বে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও বাজারজাত করা ওইসব ব্র্যান্ডের পানীয়, যার লেবেলে বর্ণিত উপাদানে কিংবা প্রকৃত পক্ষে এনার্জির পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৬০ কিলোক্যালরির কিংবা ততোধিক এরূপ এনার্জি ড্রিংকে সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা উল্লেখ করা হয়। এসআরও জারির পর এলটিইউ থেকে চিঠি দিয়েও আকিজ ফুডকে জানানো হয় বলে এনবিআর ঊর্ধ্বতন সূত্র জানিয়েছে।

যেখানে বলা হয়, আকিজ ফুডের উৎপাদিত এনার্জি জাতীয় পণ্য স্পিডের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ হারে কার্যকর হবে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এসআরও’র নির্দেশনা পরিপালন না করে বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতে রিট করে। একইসঙ্গে স্পিড নামে পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশের স্থলে ৩৫ শতাংশ হারে পরিশোধ ছাড়াই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরপর ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ সরকারের পক্ষে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন দায়ের করে। চলতি বছরের ১৯ জুন আপিল বিভাগ প্রতিষ্ঠানের আপিল খারিজ করে দেন। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের রায় অনুসারে আকিজকে ৩৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক দিতে বলা হয়।

ওই রায় অনুযায়ী এলটিইউ’র ভ্যাট বিভাগের টিম ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত (এক বছরে) স্পিড বিক্রির তথ্য সংগ্রহপূর্বক যাচাই করে বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৪ টাকা সম্পূরক শুল্ক ও ১০ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার ৩৩ টাকা ভ্যাটসহ মোট ৮৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৮ টাকা নির্ধারণ প্রতিবেদন দেয়। যা সুদসহ মোট ১৭৪ কোটি ২৬ লাখ ৪৯৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। ওই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর মূসক আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী প্রাথমিক দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। কোম্পানিটি রাজস্ব পরিশোধ না করায় চলতি বছরের ১৯ জুলাই ১৯৯১ সালের মূসক আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে। কিন্তু আকিজ ফুড কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি বলে জানা গেছে।

যদিও কোম্পানিটির কর্মকর্তারা দাবি করেছে, স্পিড এনার্জি ড্রিংকস নয়, এটি কার্বোহাইড্রেট বেভারেজ। কার্বোহাইড্রেট বেভারেজ হিসেবে বিএসটিআইর সনদও রয়েছে। কিন্তু এনবিআর এনার্জি ড্রিংকস হিসেবে রাজস্ব দাবি করেছে। বিষয়টি তার আগেও তুলে ধরা হয়েছিল।

অন্যদিকে এ বিষয়ে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরএম/এসএম