সুপারশপগুলো বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে- সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান এ অভিযোগ করেছেন। তবে এই সংবাদকে ‘অসত্য’ ও ‘ভিত্তিহীন’ বলছে সুপারশপগুলো।

সুপারশপগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা প্রতিদিন দেড় শতাধিকেরও বেশি পণ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করছে।

সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান দেশের সুপারশপগুলো পণ্যের মূল্য বাজারের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ করেন।

তিনি এক সভায় জানান, বিভিন্ন ধরনের পণ্যে ২০ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে দেশের সুপারশপগুলো। তারা বিভিন্ন পণ্যের যে দাম রাখছে, তা বাজারের তুলনায় বহুগুণ বেশি। কিন্তু সুপারশপ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর জানা যায়, সুপারশপ প্রতিনিধিরা বলছে- খোলা বাজারের তুলনায় সুপারশপে পণ্যের মূল্য পার্থক্য থাকায় তার দায় উৎপাদকদের। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণে সুপারশপের কোনো হাত নেই। সেটি উৎপাদকরাই নির্ধারণ করেন। 

পরে মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক মতবিনিময় সভায় প্যাকেটজাত মিনিকেট চাল ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিনিকেট নামে দেশে কোনো ধানের চাষ না হলেও বাজার মিনিকেট চালে সয়লাব। অভিযোগ আছে, বাজারের জনপ্রিয় এই চাল তৈরি হয়, অন্য চাল ছেঁটে। তবে এমন অভিযোগ বারবার নাকচ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি একটি ব্র্যান্ড, এই নামে চাল না থাকলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্যাকেটজাত নিত্যপণ্যের (চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, লবণ ইত্যাদি) দাম নিয়ে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভায় উৎপাদন বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সুপারশপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় প্রাণ-আরএফএলের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, অভিযোগ আছে মোটা চাল কেটে মিনিকেট চাল বানানো হয়। কিন্তু চাল ছেঁটে মিনিকেট বানানোর কোনো যন্ত্র দেশে নেই। মিনিকেট একটি ব্রান্ড, এটি বাজারে অনেক দিন ধরে আছে। এখন এটা বন্ধ করা হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের জবাবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, সাধারণত ধানের নামেই চালের নাম হয়। মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই, তাহলে এই চাল আসল কোথা থেকে। আপনাদের (ব্যবসায়ী) কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনারা জানেনই না এ চাল কীভাবে তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য আছে, মোটা চাল কেটে সরু করে সেটা মিনিকেট নামে বাজারে ছেড়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এখন আপনারা যেহেতু মানছেন না, আপত্তি তুলছেন, আমরা এ বিষয়ে চাল বিশেষজ্ঞ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসব। তারপর এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে, এমআরপি নির্ধারণে সুপারশপের হাত আছে, এমন তথ্য বিভ্রান্তিকর বলেছেন সুপারশপের প্রতিনিধিরা। সুপারশপগুলো প্রতিদিন দেড় শতাধিকেরও বেশি পণ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করছে। তারপরও দেশের সুপারশপগুলোয় সাধারণ বাজারের তুলনায় পণ্যের দাম বেশি- এমন অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সুপারশপ কর্তৃপক্ষের দাবি, সাধারণ বাজারের তুলনায় সুপারশপে মূল্য বেশি- এ অভিযোগ ঠিক নয়। সাধারণ বাজারের পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সুপারশপের পণ্যের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সুপারশপগুলো সব সময়ই পণ্য ও সেবার মান নিশ্চিত করে।

বিষয়গুলো সরকারের নজরে আনতে বাংলাদেশ সুপারশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে একটি চিঠি দেওয়া হবে। চিঠিতে যেসব বিষয় তুলে ধরা হবে তা হলো- ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্য নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য এক পাক্ষিক ও ভিত্তিহীন, সুপারশপগুলো কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করে পণ্যের এমআরপি (মূল্য) নির্ধারণ করে না, উৎপাদনকারী কোম্পানি নিজেরাই পণ্যের এমআরপি নির্ধারণ করে, সেক্ষেত্রে পণ্যের মোড়কে বা প্যাকেটে মূল্যের সঙ্গে বাড়তি দাম সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ নেই।

চিঠিতে আরও বলা হবে- দেশের রাইস মিল বা চাল উৎপাদনকারীরা মিনিকেট নামে চাল সারা দেশে বাজারজাত করছে। কাজেই সুপারশপ কর্তৃপক্ষ মিনিকেট চালের নামকরণের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। সুপারশপগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বাজারের তুলনায় ডিসকাউন্ট দিয়ে ব্যবসা করছে। এখানে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই। তাই এ ধরনের বক্তব্যও ভিত্তিহীন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপারশপ স্বপ্ন’র নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির জানিয়েছেন, স্বপ্ন ক্রেতাদের জন্য প্রতি সপ্তাহে দেড়শর বেশি পণ্যে আকর্ষণীয় মূল্য ছাড় ও প্রমোশন দিয়ে থাকে। যেমন- গত শুক্র ও শনিবার (৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর) পুষ্টি সয়াবিন তেল (৫ লিটার) ৯১০, ফ্রেশ ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার (১ কেজি) ৭৪০, ফ্রেশ লবণ (১ কেজি) ৩১ ও ইস্পাহানী ৪০০ গ্রাম চা ১৯০ টাকা অফার মূল্য ছিল। এসব পণ্যের এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) যথাক্রমে- ৯৪৫ টাকা, ৮৪০ টাকা, ৩৮ টাকা ও ২১০ টাকা। এ রকম দেড়শর বেশি প্রমোশন চলছে এখন স্বপ্নে। এর ফলে ক্রেতা সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পরিচালন ব্যয় (বিদ্যুৎ, ভাড়া ইত্যাদি) বিক্রয় মূল্যের ওপর ২২ শতাংশ। তাই আমাদের পরিচালন মুনাফা থাকে বিক্রয়মূল্যের ০.৫ শতাংশেরও কম। তাহলে অতি উচ্চ মুনাফার জায়গাটি কোথায়? আর সুপারমার্কেট তো সমগ্র বাজারের মাত্র ২ শতাংশ। তাই মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সুপারশপগুলোর কীভাবে আসে? উৎপাদকরা বিক্রয়মূল্য বা এমআরপি নির্ধারণ করেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিনা বাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও শাহীন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সুপারশপগুলোর কোনো হাত নেই। পণ্য নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা নেই। কারণ বাজারের ২ শতাংশ পণ্যও বিক্রি করি না। বড় কিছু শহর ছাড়া অন্য কোথাও সুপারশপ নেই। তাহলে কেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সুপারশপগুলোর কথায় পণ্যের দাম ঠিক করবে। 

তিনি বলেন, আমরা যখন উৎপাদন বা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পণ্য কিনি তখন একটা ছাড় পাই। কারণ এক সঙ্গে অনেক পণ্য কিনি। ওটাই আমাদের লাভ। এখন যে সুপারশপ যত বেশি বড় হবে সে তত বেশি ছাড় পাবে। এটা সারা বিশ্বে প্রচলিত। এ বাজার ধরতে কেউ শাখা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা দরকার।

পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সুপারশপগুলো ভূমিকা রাখতে পারে জানিয়ে মিনা বাজারের সিইও বলেন, সুপারশপগুলো হঠাৎ করে পণ্যের দাম বাড়ায় না। যেটা সাধারণ বাজারে ঘটে থাকে। সকালে এক মূল্য বিকেলে আরেক মূল্য। এতে করে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।

সুপারশপগুলোতে বিক্রি হওয়া পণ্যের মান নিয়ে কোনো প্রশ্নের সুযোগ নেই জানিয়ে শাহীন খান বলেন, দেশি ডাল মানে দেশি ডাল। নদীর মাছ মানে নদীর মাছ। দেশির সঙ্গে বিদেশি বা নদীর সঙ্গে সাগর মিশিয়ে পণ্য বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই সুপারশপগুলো দেশি ডালের দামই রাখবে। নদীর মাছের দামই রাখবে। তাই পণ্য ও তার মূল্য নিয়ে সুপারশপগুলো ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে না।

তিনি বলেন, মিনিকেট নামে হাজার হাজার বস্তা চাল বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। এটি আমাদের দেওয়া নাম নয়। সরকার যদি কাল এ চালের নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম দেয়, তাহলে আমরা অন্য নামেই বিক্রি করব। কোনো আপত্তি নেই। চাল উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কাজেই তাদের প্রভাবিত করে এমআরপি (মূল্য) নির্ধারণের প্রশ্নই ওঠে না।

প্যাকেটজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্যাকেটজাত পণ্যের দাম বেশি। একটা পক্ষ দাম বাড়াচ্ছে। অভিযোগ এসেছিল, উৎপাদনকারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে সুপারশপগুলো বেশি দামে বিক্রি করছে। এ বিষয়ে দুপক্ষের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে বৈঠক করেছি, তথ্যের ভিন্নতা পেয়েছি। সুপারশপগুলো দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেছে।

তবে উৎপাদনকারীদের পক্ষে সিটি গ্রুপের এক প্রতিনিধি বলেছিলেন, দাম তারা বাড়ায় না, সরকার দাম নির্ধারণ করে। তার এ তথ্য সঠিক নয়। সরকার শুধু ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করে। এর আগে একবার চিনির দাম নির্ধারণ করেছিল। আর অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য ঠিক করে দেওয়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অন্য কোনো পণ্যের দাম সরকার নির্ধারণ করে না।
 
তাহলে কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরাসরি কারা দায়ী এটা এখন বলব না, আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট উৎপাদন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, এ খাতের গবেষক ও ভোক্তা সব পক্ষের মতামত সংগ্রহ করে আমরা জানাব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের মোট বাজারের সর্বোচ্চ ২ শতাংশ অবদান রাখছে সুপারশপগুলো। সমস্যা তো এখানেই। যদি এমন হতো, সুপারস্টোরগুলো অনেক পণ্য বিশাল পরিমাণে বিক্রি করতে পারত ও অর্ডার দিয়ে অনেক পণ্য কিনতে পারত- তাহলে তাদের খরচ কম হতো। বিদেশে যেটা হয়, একত্রে এক লাখ টন পণ্য কিনে একটু কম দামে বিক্রি করছে তারা। বাংলাদেশে এটা তো হচ্ছে না। দেশে তো উল্টো খোলা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে সুপারশপগুলোকে। উন্নত দেশে এরকম খোলা বাজার কোথাও নেই। বরং পাড়ার দোকান বা মুদি দোকানে একেক ভোক্তার কাছে একেক দামে পণ্য বিক্রি করছে।

তিনি বলেন, দেশের সুপারশপগুলোতে বেশি বিক্রি হয় প্যাকেটজাত পণ্য। পণ্যের বিক্রয় মূল্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গায়ে লিখে দেয়। এখানে সুপারশপগুলোর মূল্য বাড়ানোর সুযোগ থাকে না। আর খোলা পণ্য যেগুলো বিক্রি হয়। সেখানে একটু দাম বেশি হতে পারে। কারণ একটা সুপারশপের পরিবেশ সাধারণ বাজারের দোকানের চেয়ে ভালো, ভাড়া বেশি, ভ্যাট দিতে হয়, পরিচালন ব্যয়ও বেশি। এসব কারণে খোলা পণ্যের দাম একটু বেশি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তাদের ব্যবসা করেই চলতে হবে।      

মীজানুর রহমান বলেন, সুপারশপে গুণগত মানের পণ্য বিক্রি হয়। একজন সচেতন ভোক্তা খোলা বাজার থেকে পণ্য কিনে এ আস্থা পাবেন না। খোলা বাজারে সবসময় একটা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে কেনাকাটা করতে হয়। যখন একটি ব্র্যান্ডের চাল কিনবেন তখন একটা আস্থা আসবে। এটাই হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। একটা ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর জন্য তাদের অনেক খরচও করতে হয়। যারা মানসম্পন্ন পণ্য চান তারা সুপারশপে যাবেন, আর খোলা বাজারে যাওয়ার জন্য তো ৯৮ শতাংশ অপশন থাকছেই। তবে সুপারশপগুলো যত বেশি হবে তত কম দামে ভোক্তারা পণ্য কিনতে পারবেন।

এসআই/এআর/ওএফ