চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিবছরই বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নিমার্ণ করা হচ্ছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। এই প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে ফিনিশিং। এই টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে অন্তত ৫ লাখ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

আগামী ২১ জুলাই খোলা পণ্যের জাহাজ ভেড়ানোর মধ্যে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হবে টার্মিনালটির কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিসিটি চালু হলে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমবে, টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমবে, আমদানি ও রপ্তানি গতিশীল হবে। এক কথায় দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এ টার্মিনাল। 

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখানে ৬০০ মিটার জেটিতে একসঙ্গে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের ও ৯.৫ মিটার ড্রাফটের তিনটি কনটেইনারবাহী জাহাজ এবং ২২০ মিটার দৈর্ঘ্যের ডলফিন জেটিতে একটি তেলবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। যার ধারণক্ষমতা প্রায় ৬  হাজার টিইইউ কনটেইনার। আর এ টার্মিনালের জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর মধ্য দিয়ে ২০০৭ সালের পর নতুন কোনো জেটিতে প্রথম জাহাজ ভিড়তে যাচ্ছে। 

বন্দরের সচিব ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বড় হচ্ছে। সে অনুযায়ী আমরা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছি। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম। এর কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। ২১ তারিখ পরীক্ষামূলকভাবে একটি জাহাজ ভেড়ানো হবে। চূড়ান্ত উদ্বোধন মাস দুয়েক পরে করা হবে। 

তিনি বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের চারটি জেটির মধ্যে তিনটি কনটেইনারবাহী, আর একটি তেলবাহী। কনটেইনারবাহী তিনটি জেটি চালু হলে আমরা বছরে প্রায় ৫ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারব। এর ফলে আমদানি-রপ্তানিও গতিশীল হবে, জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমবে, টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমবে। সর্বোপরি দেশের আমদানি-রপ্তানিতে গতি আসবে।  বিভিন্ন সময়ে শুনি জাহাজ অপেক্ষমাণ থাকার কারণে প্রচুর পরিমাণে টাকা গচ্চা দিতে হয়। সেটা আর হবে না বলে আশা করছি।। জাহাজ আসার সঙ্গে সঙ্গে বার্থিং হবে।   

আরও পড়ুন : পাঁচ কোটি টাকার কাজে বিল উত্তোলন ১১ কোটি!

তিনি বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল মোহনা থেকে কাছেই। জাহাজের  বার্থিং পেতে সাধারণত যে সময় লাগে, সেটাও কম লাগবে পিসিটিতে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি থেকে ভাটির দিকে ড্রাই ডক এনং বোটক্লাবের মধ্যবর্তী প্রায় ২৬ একর জায়গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে এ কনটেইনার টার্মিনাল। জানা গেছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ( পিপিপি) পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন প্রকল্পটির জন্য আন্তর্জাতিক মানের বেসরকারি অপারেটর নিয়োগ করা হবে। টার্মিনাল অপারেশন পরিচালনা ও বিনিয়োগ প্রস্তাবে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতের আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরের পিএসএ এ ক্ষেত্রে নিজেদের আগ্রহ দেখিয়েছে।  

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে বন্দর সচিব  বলেন, এই জেটিতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। প্রথমত চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ শুরু করা হবে। সরকারি পর্যায়ে গ্লোবাল অপারেটর নিয়োগের কার্যক্রম চলমান আছে পিপিপি অথরিটির মাধ্যমে। এটা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত বন্দরের নিজস্ব জনবল দিয়ে চালাবো।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে পরীক্ষামূলক জাহাজ ভেড়ানো হবে ২১ জুলাই। এর মাধ্যমে জেটিতে যেসব যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়েছে সেগুলো দেখার জন্য কিছুদিন পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চলবে। তারপর সেপ্টেম্বরে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের চিন্তা-ভাবনা করছি। 

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের গ্রোথ বাড়ছে। গ্রোথ সামাল দেওয়ার জন্য  বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি, জেটি, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হয়। বন্দরের যে গ্রোথ সেটাকে সামাল দেওয়ার জন্য পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু করতে চাচ্ছি। এর ফলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে। একসঙ্গে চারটি জাহাজ বার্থিং করা যাবে পিসিটিতে। চট্টগ্রাম বন্দরে এর ফলে বেশি পরিমাণে কনটেইনার রাখা যাবে ও একসঙ্গে বেশি পরিমাণে জাহাজ বার্থিং করা যাবে। 

আরও পড়ুন : রূপসা রেল সেতুতে বসেছে সবগুলো স্প্যান, চলছে রেললাইনের কাজ

এ টার্মিনালের জন্য সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে পোশাক শিল্প। 

বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, প্রথম দিনে বাল্ক জাহাজ ভেড়ানোর মাধ্যমে ইয়ার্ডের কার্যক্রম চালু করা হবে। পরবর্তীতে কনটেইনারবাহী জাহাজও ভেড়ানো হবে। তবে এক্ষেত্রে গিয়ারড জাহাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পিসিটিতে ভেড়ানোর সুযোগ পাবে। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ইকুইপমেন্টের পাশাপাশি জাহাজের ক্রেন দিয়ে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং করা হবে। তাই সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগ করার পরিকল্পনা আছে। কয়েকটি গ্লোবাল অপারেটরের সঙ্গে কথা চলছে।  অপারেটর নিয়োগ করার আগ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব যন্ত্রপাতি দিয়ে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সেই সক্ষমতা বন্দরের রয়েছে। 

তিনি বলেন, ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ  ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যর জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কাজ করছি। এর ফলে একসঙ্গে বেশি কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তে পারে। 

ডিপিএম (সরাসরি সংগ্রহ পদ্ধতি) পদ্ধতিতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল  প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ২০১৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও গত বছরের শুরুতে তা চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা ডিসেম্বরে চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ডিসেম্বরেও তা সচল করতে না পারার পর এবার তা জুলাইয়ে এসে পরীক্ষামূলকভাবে সচল হচ্ছে।

আরও পড়ুন : এলডিসি উত্তরণের পরও টিআরআইপি ছাড় পেতে পারে বাংলাদেশ

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশেরও বেশি চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে হ্যান্ডলিং হয়। যদিও এ বন্দরে বর্তমানে জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নামের তিনটি টার্মিনালে মোট ১৯টি জেটি রয়েছে। পাশাপাশি তেল খালাসের জন্য রয়েছে চারটি ডলফিন জেটি। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোর পাশে ইয়ার্ড এলাকার মোট পরিমাণ ৮ লাখ বর্গমিটার। এ বন্দরের মাধ্যমে গেল অর্থবছরে প্রায় ৩২ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। 

কেএম/এনএফ