ঈদকে সামনে রেখে ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে ফ্যাশন হাউসগুলোয়/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

একসময় দেশের বাজারে বিদেশি ব্র্যান্ডের দাপট ছিল আকাশ ছোঁয়া। সময়ের ব্যবধানে সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের পরিচয় অন্যতম সেরা পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। বর্তমানে বাজারের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর কাপড় ও ডিজাইন দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে।

দিন যত যাচ্ছে আড়ং, অঞ্জনস, ইনফিনিটি কিংবা সেইলরের মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঈদের বাজারে দেশীর ব্র্যান্ডগুলোর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব ব্র্যান্ডের পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। তবে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে দাম ও মান নিয়ে। 

ক্রেতাদের অভিযোগ দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে অনেক বেশি দাম নিচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউসের পণ্য। 

রাজধানীর মুগদা থেকে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের আড়ংয়ের শো-রুমে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। পাঞ্জাবি পছন্দ করতে গিয়ে অনেকটা অভিযোগের সুরে বললেন, আড়ংসহ দেশি ব্র্যান্ডগুলোতে মানুষের চাপ বেশি থাকে। কারণ এসব জায়গায় ডিজাইনের ভিন্নতা রয়েছে। এখানে কাপড় ও ডিজাইনের বিবেচনায় পাঞ্জাবির দাম বেশি মনে হচ্ছে। যে পাঞ্জাবির দাম তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা, বাইরে একই মানের পাঞ্জাবি দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আমার ধারণা ব্র্যান্ড হিসাবে তারা বেশি দাম রাখছে। এটা দেখার কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত আমরা কাউকে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে আড়ংয়ের পণ্যকে বেশি অগ্রাধিকার দিই। সে কারণেই বেশি ক্রয় করা হয় আড়ংয়ের পণ্য। আমার ধারণা ব্র্যান্ড হিসেবে তারা সেই সুযোগটা নিচ্ছে। এরূপ চলতে থাকলে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো এক শ্রেণির ক্রেতাদের হারাবে। 

বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের ৮টি শহরে ২১টি শাখার মাধ্যমে আড়ং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ঈদ বাজার ও ক্রেতাদের অভিযোগসহ সার্বিক বিষয়ে আড়ংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল্লাহর রহমতে এ বছরের বিক্রি অনেক ভালো। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে নিতে পেরেছি। এমনকি যদি করোনার আগে ২০১৯ সালের সাথেও তুলনা করি তাহলে বলতে হবে আমাদের বিক্রি অনেক ভালো।

অতিরিক্ত দামের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সেল প্রাইসিং সিস্টেম খুবই পরিচ্ছন্ন। আমাদের পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় ওই পোশাকে কি ধরনের কাপড় ও কাজ যোগ হচ্ছে সেটার ওপর ভিত্তি করে। যেমন; কাপড়ের কাজে এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট কিংবা কি ধরনের হাতের কাজ যোগ হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে পোশাক বা পণ্যের চূড়ান্ত দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এরপর ফিক্সড মার্কার সিস্টেম অনুসরণ করা হয়। ফলে দেশের যে কোনো আউটলেটে একই দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পরিপূর্ণ অটোমেটেড সিস্টেম অনুসরণ করতে হয় আমাদের। আমরা চাইলেও দাম কমাতে কিংবা বাড়াতে পারি না। ফলে আমাদের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার সুযোগ নেই।

ছেলে-মেয়েদের সকল ধরনের পণ্যের দেশীয় ব্র্যান্ড সেইলর। সারাদেশে তাদের ১৮টি আউটলেট রয়েছে। ঈদের কেনাকাটায় তাদের অবস্থানও বেশ ভালো। গত দুই বছরের করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে এ বছর ভালো মুনাফা করার আশায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে সেইলরের শো-রুমে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

এখানেও অতিরিক্ত দামের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রামপুরা থেকে আসা সাওমি আহমেদ বললেন, পোশাকের কালেকশন বেশ ভালোই দেখতে পাচ্ছি। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেশি মনে হচ্ছে। কাপড়ের মান ও দামের হিসাব মিলাতে পারছি না। কাপড়ে মান হিসাবে অনেক পোশাকের দাম তুলনামূলক বেশি। 

এ বিষয়ে সেইলরের খিলগাঁও শাখার ম্যানেজার ইয়ামিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদ বাজার হিসাবে বিক্রি অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ২০ রোজার পর থেকে বিক্রি বেড়েছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। আপনি যে অভিযোগের কথা বলছেন, মাঝে মধ্যে এমন অভিযোগ পাই। তবে আমি মনে করি আমাদের পণ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি ঠিক নয়। আমরা সকল ধরনের ক্রেতার চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে পোশাক তৈরি করছি। বাড়তি দাম ওইভাবে পাবেন না।

যদিও কয়েকগুণ লাভে পোশাক বিক্রির সত্যতা পাওয়া যায় বিভিন্ন সময় সরকারি সংস্থার অভিযানে। গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর বনশ্রীতে অবস্থিত আর্টিসানের শো-রুমে বিশেষ অভিযান চালিয়ে এমন অভিযোগের সত্যতা পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানে চারগুণ লাভে পোশাক বিক্রির সত্যতা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, প্যাকেটের গায়ে লেখা এক দাম; আবার পোশাকের গায়ে লাগানো ট্যাগে লেখা আরেক দাম পাওয়া যায়। এছাড়া কোনো কোনো প্যাকেটের গায়ে লাগানো ‘পণ্যমূল্য এবং বারকোড’ কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে ভোক্তা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্ট‌কে বলেন, আর্টিসান শুধু চারগুণ লাভই করছে তা নয়। বনশ্রীতে প্রতিষ্ঠানটির শো-রুমে দেখা যায়, সাদা রংয়ের একটি শার্টের প্যাকেটের গায়ে লেখা ১৬৯৫ টাকা সাথে ভ্যাট। কিন্তু শার্টের গাঁয়ে ট্যাগে লেখা ১১৯৫ টাকা সাথে ভ্যাট। আরও অভিযোগ রয়েছে আর্টিসানের বিরুদ্ধে। তারা শার্টের প্যাকেটের গায়ে লেখা দাম এবং বারকোড কালি দিয়ে মুছে দিয়ে সেগুলো বেশি দামে বিক্রি করছে।

করোনাভাইরাসের মহামারিতে বাঙালির উৎসবের ক্যালেন্ডারে গত চারটি ঈদ আর দুটি বৈশাখের রঙ মুছে দিয়েছিল প্রায়। পোশাক ব্যবসায়ীদের জন্য ২০২০ আর ২০২১ ছিল মন্দার বছর। সংক্রমণ কমে আসায় ঈদে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা একটু বেশি। তাদের প্রত্যাশা পূর্বের ক্ষতি পুষিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে চলতি বছর।

আরএম/এসকেডি